স্বপনকে গ্রেফতার করা হল সুশীলের দেখিয়ে দেওয়া ডেরা থেকে। কাকা-ভাইপোকে নিয়ে গোয়েন্দাবিভাগের টিম কলকাতা রওনা দেওয়ার পর গাড়িতে গা এলিয়ে দেন মলয়। যাক, ছুটির অ্যাপ্লিকেশনটা এবার করে ফেলতে হবে। আর রাসবিহারীর ধাবার ম্যানেজার ভদ্রলোককেও একটা থ্যাঙ্কস দিয়ে আসতে হবে কাল। ভাগ্যিস সবজিটা অমন বিস্বাদ হয়েছিল, ভাগ্যিস উঠেছিল ক্যানিং-এর কথা। আছে আছে, মলয় দত্তের টেলিপ্যাথির জোর আছে!
বারুইপুর থেকে কলকাতায় ফেরার পথে মলয়কে খুনের বৃত্তান্ত খুলে বললেন সুশীল-স্বপন। জানা গেল, ঠিক কী ঘটেছিল।
সুশীলের বয়স বাইশ-তেইশ। স্বপনের মধ্যতিরিশ। দু’জনেরই রুজিরোজগার অন্যের জমিতে চাষবাস করে। মাঝেমাঝে সবজি বেচতে আসতেন কলকাতায়, হোটেল-ধাবায়।
ঘোর অর্থাভাব ছিল দু’জনেরই। সুশীলের বাবা ছিলেন প্রতিবন্ধী। মা-ও ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রান্নাঘরে পড়ে গিয়ে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন মাথায়। সংসার চালানোর পুরো দায়িত্বই ছিল সুশীলের উপর। যে দায়িত্ব দুর্বহ হয়ে উঠছিল দিনের পর দিন। চাষবাসের কাজ করে কতটুকুই বা আয় হয়? তবু কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত কোনওরকমে। মায়ের অসুস্থতার পর অর্থসংকট গভীর হয়েছিল। চিকিৎসার খরচেই মাসিক উপার্জনের অর্ধেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করার পর এমনিই খরচ বেড়েছিল সংসারের। টুম্পার ছোটখাটো সাধ-আহ্লাদ মেটাতে পারতেন আগে। এখন সে পাটও চুকেছে। বউয়ের মুখ আজকাল গোমড়াই থাকে সারাক্ষণ।
এভাবে আর কতদিন? রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবতেন সুশীল। ঘটিবাটি বন্ধক রাখতে হবে এবার। কিন্তু তা দিয়েই বা কী হবে? বাড়িতে কী-ই বা আছে তেমন দামি কিছু? খেয়েপরে বাঁচতে গেলে, মায়ের চিকিৎসা চালাতে গেলে, টাকার দরকার। বেশ কিছু টাকার। কে দেবে? ধার নিলে আর এক বিপদ। শোধ তো দিতে হবে সুদসহ। না পারলে কাকার মতো অবস্থা হবে।
‘কাকার মতো অবস্থা’ মানে পাওনাদারদের তাগাদায় ভিটেছাড়া হওয়া। স্বপন সর্দারের জুয়ার নেশা ছিল দুরারোগ্য পর্যায়ের। যা রোজগার করতেন, পুরোটাই উড়িয়ে দিতেন জুয়ার ঠেকে। ফলে অবধারিত আর্থিক অনটন এবং পেট চালাতে ধার করা। পাওনাদাররা সকাল-সন্ধে হানা দিত স্বপনের বাড়িতে। ধার শোধ দিতে অপারগ স্বপন বাধ্য হয়েছিলেন বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে। আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু সেখানে, এ-ভাবেই কাটত।
কাকার মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো অসম্ভব মা-বাবা-বউকে ছেড়ে। তার চেয়ে
চুরি-ডাকাতি করাই বোধহয় ভাল। যা হবে, দেখা যাবে। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই একদিন মাথায় এল কালীঘাটের ‘দিদার’ কথা। টুম্পার মা ওই বাড়িতে অনেক বছর ধরে কাজ করেন। বিয়ের পর টুম্পাকে নিয়ে গিয়েছিলেন একবার ওই ফ্ল্যাটে। শাশুড়িই নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়ে-জামাইকে। ওই দিদার কাছে টাকা ধার চাইলে কেমন হয়? কিন্তু যদি না দেয়? কথা নেই বার্তা নেই, এতদিন পরে হুট করে গিয়ে টাকা চাইলে না দেওয়ারই কথা। না দিলে? সুশীল মনস্থির করে ফেলেন।
পরের সন্ধেয় কাকা-ভাইপোর দেখা হয়। সুশীল খুলে বলেন প্ল্যান।
—কালীঘাটে এক বুড়ি দিদার বাড়ি চিনি আমি। দাদু মারা গেছে। দাদু-দিদা দু’জনেই ভাল চাকরি করত। গিয়ে টাকা চাইব। না দিলে কেড়ে নেব। যাবে?
না গিয়ে উপায়ও ছিল না স্বপনের। আর্থিক সংকট থেকে রেহাই পেতে তিনিও একই রকম মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। স্বপন রাজি হয়ে গেলেন। এবং ৬ নভেম্বর ভোরের ট্রেনে চড়ে বসলেন কাকা-ভাইপো। খুন-জখম বাদ দিন, ছিঁচকে চুরি বা পকেটমারিরও কোনও পূর্বইতিহাস ছিল না যাঁদের।
সুশীল একটা ছুরি নিলেন সঙ্গে। আর একটা চটের ব্যাগ মাঝারি সাইজ়ের। যাতে রইল টাটকা সবজি কিছু।
মঞ্জুর ফ্ল্যাটে বেল বাজল ন’টা নাগাদ। উষা এবং জগদীশ তখন কাজ সেরে বেরিয়ে গেছেন। মঞ্জু বাড়িতে একা। ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’
—দিদা, আমি সুশীল। উষার জামাই। আপনার জন্য একটু টাটকা সবজি নিয়ে এসেছি। এদিকে কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।
অচেনা লোক নয়, উষার জামাই। আগেও এসেছে একবার। মঞ্জু দরজা খুলে দিলেন। সুশীল ফ্ল্যাটে ঢুকলেন কাকাকে নিয়ে।
—দিদা, এঁর নাম স্বপন। আমার কাকা।
চটের ব্যাগ থেকে সবজি বার করলেন সুশীল। মঞ্জু রেখে এলেন রান্নাঘরের ঝুড়িতে। এতদূর থেকে সবজি নিয়ে এসেছে, এক কাপ চা না খাওয়ালে খারাপ দেখায়। উষাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসেন। তার জামাইকে চট করে বিদায় করে দেওয়া যায় না। সুশীল-স্বপনকে নিজের ঘরে বসিয়ে চা তৈরি করতে রান্নাঘরে ঢুকলেন মঞ্জু। নিজের জন্যও বানালেন এক কাপ।
চা খেতে খেতে এটা-সেটা কথার মধ্যেই সুশীল পাড়লেন টাকার কথা। বড্ড টানাটানি যাচ্ছে, কিছু টাকা ধার পেলে ভাল হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোধ দিয়ে দেবেন। মঞ্জু এবার বিরক্ত হলেন। এ যে দেখি খেতে পেলে শুতে চায়! সটান বলে দিলেন, ‘টাকা দিতে পারব না। আর উষা জানে, তোমরা এসেছ আজ?’ সুশীল যেটা সত্যি, সেটাই বললেন। উষা সত্যিই জানতেন না জামাই এবং তার কাকার এই প্ল্যানের বিন্দুবিসর্গও।
‘তোমরা এখন যাও’ বলে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ছেড়ে মঞ্জু উঠে দাঁড়ানো মাত্রই তাঁর হাত চেপে ধরলেন সুশীল। বাকিটা রইল সুশীলেরই বয়ানে।