মলয় বোঝেন, এবার আইডেন্টিটি কার্ডটা বার করা দরকার। লালবাজারের গোয়েন্দা, পরিচয় পেয়ে ম্যানেজারের ব্যবহার বদলে যায় নিমেষে। কেজো ভদ্রতার জায়গা নেয় সমীহ।
—কী ব্যাপার স্যার, কিছু ফেলে গেছেন?
—না, আচ্ছা ওই ক্যানিং-লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে সবজি আসে বলছিলেন না? ক্যানিং থেকে কারা আসে?
—এক-দু’জন নয় স্যার, পাঁচ-ছ’জন আসে। রোজ রোজ একই লোক তো আসে না। কোনওদিন দু’জন এল, কোনওদিন হয়তো তিন বা চার। কেন স্যার? কী ব্যাপার?
—ক্যানিং থেকে সবজি শেষ কবে এসেছিল এখানে?
—পরশু, বা তরশু হবে।
—তার আগে?
—তার আগে… তার আগে… সপ্তাহখানেক আগে বোধহয়… দাঁড়ান রেজিস্টারে তো লেখা থাকে কবে কোথাকার মাল ঢুকল।
—সপ্তাহখানেক আগে যারা সবজি দিয়ে গিয়েছিল, তাদের চেহারা মনে আছে?
—না স্যার, ডেলিভারি কর্মচারীরা নেয়, আমার তো কাউন্টারে বসেই কাটে বেশিরভাগ সময়টা…
—আপনি রেজিস্টারটা বের করে রাখুন, আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি ঘুরে। ডেলিভারি যারা নেয়, তাদের সঙ্গে কথা বলব।
ম্যানেজার আঁচ করতে পারেন, গুরুতর কিছু একটা ব্যাপার আছে ক্যানিং-এর সবজি নিয়ে। জিজ্ঞেস করে ফেলেন, স্যার, শুধু ক্যানিং, না লক্ষ্মীকান্তপুর-বজবজও দেখে রাখব?
—আপাতত শুধু ক্যানিং। আসছি ঘুরে।
ঘুরে আর এলেন না মলয়। প্রয়োজন পড়ল না। উষারানিকে কালীঘাট থানায় ডেকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন সাড়ে চারটে নাগাদ। প্রাথমিক জেরায় উষা বলেছিলেন, এক মেয়ে তাঁর। বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তেমন। এবারও একই কথা বললেন। কিন্তু মলয় এবার আর সেই ভুল করলেন না, যেটা প্রথমবার করেছিলেন। মঞ্জুদেবীর মেয়ে মানসী এককথায় উষারানিকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়ার পর সেভাবে আর গভীরে গিয়ে নাড়াচাড়া করেননি ওঁর পরিবারের দিকটা। এবার করলেন।
—কোথায় থাকে আপনার মেয়ে-জামাই?
—ক্যানিং লাইনেই থাকে। বারুইপুরের দিকে। গ্রামের নামটা জানি না।
—মেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না?
—না স্যার, ন’মাসে ছ’মাসে একবার।
—শেষ কবে দেখা হয়েছিল?
—মাস ছয়েক আগে স্যার। টুম্পার, মানে আমার মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সময়। বাচ্চাটা বাঁচেনি। হাসপাতালেই মারা গিয়েছিল।
মলয় আর দুটো প্রশ্ন করেন শুধু।
—জামাইয়ের নামটা বলুন। আর বাচ্চা হওয়ার সময় কোন হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল টুম্পা?
—সুশীল সর্দার। ক্যানিং সদর হাসপাতাল।
সন্ধেয় আর বাড়ি ফেরা হয় না উষারানির। আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বসিয়ে রাখা হয় থানায়, মহিলা পুলিশের জিম্মায়।
বাড়ি ফেরা হয় না মলয়েরও। যাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, ক্যানিং-কানেকশনেই লুকিয়ে আছে রহস্যের চাবিকাঠি। ওসি হোমিসাইডকে জানালেন সব। সাত-আটজন অফিসারের টিম পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছল কালীঘাট থানায় এবং রওনা দিল পত্রপাঠ। গন্তব্য, ক্যানিং সদর হাসপাতাল।
যেতে যেতেই মোবাইলে মানসীকে ধরলেন মলয়।
—মায়ের বাজার তো আপনিই করে দিতেন, না?
—হ্যাঁ, সপ্তাহে একবার। সাত-আটদিনের বাজার করে দিয়ে আসতাম। হয় আমি, নয়তো হাজ়ব্যান্ড।
—সবজি কেনাকাটার আলাদা লোক ছিল?
—না তো! আমিই যা কেনার, কিনে দিয়ে আসতাম। কেন?
—এমনিই। অন্য কেউ তরিতরকারি দিতে আসত না, শিয়োর আপনি?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তেমন কেউ থাকলে আমি জানব না, হয়?
—আচ্ছা, মায়ের মৃত্যুর কতদিন আগে বাজার, আই মিন, সবজি-বাজার করে দিয়ে এসেছিলেন?
একটু ভেবে মানসী উত্তর দেন, ‘দিনপাঁচেক আগে হবে। কেন বলুন তো?’
—না, তেমন কিছু না। থ্যাঙ্ক ইউ।
কৌতূহলী মানসী আর কোনও প্রশ্ন করার আগেই ফোন রেখে দিয়েছিলেন মলয়। গাড়ি ছুটছিল ক্যানিং-এর দিকে, আর ধমনীতে অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ দিব্যি টের পাচ্ছিলেন মলয়। সেই অনুভূতি, যা শব্দ খরচ করে বোঝানো দুঃসাধ্য। যা তদন্তকারী অফিসারমাত্রই অনুভব করেন কোনও জটিল মামলার সম্ভাব্য কিনারার অতর্কিত আভাসে। মানসী বলছেন, খুনের পাঁচ দিন আগে বাজার করে দিয়ে এসেছিলেন। আর কোন লোক ছিলও না তরিতরকারি সাপ্লাই করার। তা হলে পাঁচদিন পরও ঝুড়িভরতি সবজি থাকে কী করে? কারা দিয়ে গিয়েছিল সবজি? কবে? কখন?
ডিসি সাউথ ফোন করে রেখেছিলেন ক্যানিং হাসপাতালের সুপারকে। সুপার নিজেই উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট রেজিস্টার নিয়ে। হ্যাঁ, মাসছয়েক আগে একটি সদ্যোজাতা শিশুকন্যা মারা গিয়েছিল প্রসবের পরেই। মায়ের নাম টুম্পা সর্দার। বাবার নাম সুশীল সর্দার। ঠিকানা, বারুইপুর থানার মাঝেরহাট গ্রাম।
মলয় যখন টিম নিয়ে মাঝেরহাট গ্রামে সুশীলের বাড়িতে কড়া নাড়লেন, রাত প্রায় ন’টা। সুশীল পুলিশ দেখে হকচকিয়ে গেলেন। মলয় সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘গয়নাগাটি যা কালীঘাট থেকে পেয়েছিলেন, বার করুন, আর যেটা দিয়ে খুনটা করেছিলেন, সেটাও।’
সুশীল ‘কোন খুন? আমি কিছু জানি না!’ জাতীয় প্রতিরোধের রাস্তায় গেলেনই না। কবুল করলেন সোজাসাপটাই, ‘বলছি স্যার, সব বলছি। তবে আমি একা করিনি। কাকাও ছিল।’
—কাকা?
—স্বপন সর্দার, কাছেই থাকে।
—নিয়ে চলুন কাকার বাড়ি।
—বাড়িতে পাবেন না স্যার। বাজারে কাকার অনেক ধারদেনা। পাওনাদারদের জ্বালায় বাড়িতে থাকে না। আমি জানি কোথায় থাকে। চলুন।