সুমিত উঠতে যাবেন, মলয় বসিয়ে দেন হাত ধরে।
—চা খেয়ে যান অন্তত। না হলে লালবাজারের বদনাম হবে। এতক্ষণ কথা বললাম, আর এক কাপ চা-ও অফার করলাম না!
লালবাজারের চায়ে বা সুনাম-বদনামে এতটুকু আগ্রহী দেখায় না সুমিতকে।
—নাহ, তার দরকার নেই। আমার এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেক।
—আচ্ছা, চা নয়, জল তো এক গ্লাস খেয়ে যান। না হলে ওই যে কথায় বলে না, গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।
সুমিতকে এইবার রাগত দেখায়। পুলিশের এই ‘গৃহস্থপনা’ অসহ্য ঠেকে। একে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই ছোট্ট ঘরে বসিয়ে চাপ দিচ্ছে, মুখের উপর ‘খুনি’ বলছে। তারপর ‘জল খেয়ে যান, চা খাবেন?’-এর ন্যাকামি। নেহাত এটা লালবাজার আর এই অকালপক্ব মলয় ছোকরাটা পুলিশ অফিসার। না হলে …।
কিছু বলতে গিয়েও সুমিত সংবরণ করেন নিজেকে। জলের গ্লাস এলে ঢকঢক করে খেয়ে বেরিয়ে যান।
এবং বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘সায়েন্টিফিক উইং’-এর অফিসারদের ডাকেন মলয়। গ্লাসে আঙুলের ছাপ পড়েছে সুমিতের। ‘ডেভেলপ’ করে মঞ্জুদেবীর ফ্ল্যাটে আলমারি আর চায়ের কাপে পাওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করানোর জন্য টিম রওনা হয়ে যায় ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। ডিসি ডিডি ফোন করেন ল্যাবরেটরির ডিরেক্টরকে, ‘রিপোর্টটা একটু তাড়াতাড়ি পেলে ভাল হয়।’
তাড়াতাড়িই পাওয়া গেল, এবং মলয়কে হতাশায় ডুবিয়ে সেই রিপোর্ট জানাল, ‘ম্যাচ’ করেনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট। মিলছে না সুমিতের আঙুলের ছাপ ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া ছাপের সঙ্গে।
এবার? অপরাধ স্বীকার করছেন না সুমিত। প্রমাণও হাতে নেই। আঙুলের ছাপও মিলল না। এবার? খুনটা তা হলে কে বা কারা করল? একদম অচেনা চোর-বদমাইশ কেউ? কিন্তু তা-ই বা হয় কী করে? সকালে কেউ করে এসব এভাবে? আর ঘুরেফিরে সেই পরিচিতির তত্ত্ব, অচেনা কাউকে দরজা খুলবেনই বা কেন মঞ্জু?
খুনটা তা হলে আনডিটেকটেড থেকে যাবে? দশ দিন হয়ে গেল। কিনারা করা গেল না, ‘এখনও অন্ধকারে পুলিশ’ জাতীয় স্টোরি তো প্রায় রোজই বেরচ্ছে খবরের কাগজে। অন্ধকারে আর কতদিন থাকতে হবে?
হতোদ্যম মলয় যখন বাড়ি ফিরছেন ১৮ নভেম্বরের রাতে, ভাবতেও পারেননি অন্ধকার কাটতে চলেছে দ্রুত। আলোর ফুলকি দেখতে পাবেন খুব শিগগিরই।
.
রুটি, আলু-গোবি, বেগুন ভর্তা।
অর্ডার দিয়ে অন্যমনস্ক বসে ছিলেন মলয়। বীরভূমে গ্রামের বাড়িতে শেষ গিয়েছেন প্রায় চার মাস হয়ে গেল। সেই জুলাইয়ে। পুজোয় ছুটিছাটার প্রশ্ন নেই। কিন্তু তারপরেও কাজের চাপে আর যাওয়া হল কই? বিজয়ার প্রণামটাও এখনও সারা হয়নি। ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দেবেন-দেবেন করছিলেন, তার মধ্যেই এই মহিলার খুন। এখন আর কিনারা হওয়ার আগে মুখ ফুটে বলাও যাবে না ছুটির কথা। এদিকে বাড়ি থেকে রোজই ফোন আসছে মা-বাবার, ‘কবে আসবি?’
আর আসা! সপ্তাহদুয়েক হতে চলল, তদন্ত আর এগোল কই? রোজ প্রায় একডজন সোর্সের সঙ্গে কথা বলছেন। মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। যা যা করা সম্ভব, করছেন সাধ্যমতো। অথচ না আছে ক্লু, না আছে কিছু।
খাবার এসে গেছে। চেতলার এক সোর্সের সঙ্গে দেখা করতে ভোর ভোর মলয় চলে এসেছিলেন কালীঘাট এলাকায়। তখনকার চা-টোস্ট হজম হয়ে গিয়ে এখন খিদে পেয়েছে বেজায়। রাসবিহারী মোড়ের ধাবায় ঢুকেছেন লাঞ্চ সারতে।
খাবার মুখে দিয়ে খিঁচড়ে থাকা মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে যায় মলয়ের। একটা অদ্ভুত মশলা দেয় এরা এইসব ধাবাগুলোয়। সবজির স্বাভাবিক স্বাদটাই নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ির রান্নার মতো হবে না ঠিকই, কিন্তু তা বলে এই?
—আর দুটো রুটি বলি?
ম্যানেজারের প্রশ্নের উত্তরে বিরক্তি লুকোতে পারেন না মলয়।
—আরে না মশাই, রান্নার যা ছিরি আপনাদের…
—কেন?
—সবজিটা খেয়ে দেখলেই বুঝবেন, কেন। কোনও স্বাদই নেই।
—কেন, সবজি তো ফ্রেশই ইউজ় করি আমরা।
ডিপার্টমেন্টে মলয় ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু সময় খারাপ গেলে যা হয়, স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই হঠাৎ মেজাজ হারালেন।
—আমি গ্রামের ছেলে মশাই। এখনও বাড়ি গেলে চাষের কাজে হাত লাগাই। আমাদের ভীমগড় বাজারের সবজি খেলে বুঝতে পারতেন, কোনটা টাটকা আর কোনটা নয়। ফ্রেশ সবজি চেনাবেন না আমাকে।
ম্যানেজার আর থাকতে পারেন না।
—কিছু মনে করবেন না। রান্নার এদিক-ওদিক হতে পারে, কিন্তু বাসি মাল আমাদের এখানে পাবেন না। এখানেও টাটকা সবজিই আসে। ক্যানিং থেকে, লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে, বজবজ থেকে। ট্রেনে করে এসে লোক দিয়ে যায়। আশেপাশের ভাতের হোটেলেও দেয়। অনেক বাড়িতেও দেয়।
মলয় আর কথা বাড়ান না। খারাপই লাগে একটু। সামান্য ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে খিটখিট না করলেই হত। বিল মিটিয়ে কাউন্টার থেকে মৌরি–মিছরি মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাস্তুহারা বাজারে একজন সোর্স অপেক্ষা করছে।
কিছুটা হাঁটার পরই থমকে যান মলয়, মস্তিষ্কে হঠাৎই বিদ্যুৎঝলক। কী যেন বললেন ম্যানেজার ভদ্রলোক? ক্যানিং-লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে সবজি আসে? আর সেই সবজি আশেপাশের বাড়িতেও সাপ্লাই হয়? ক্যানিং… ক্যানিং… উষারানির বাড়ি তো ক্যানিং-এ। আর, খুনের দিন মঞ্জুদেবীর রান্নাঘরে ঝুড়িভরতি সবজি তো এখনও ভাসছে চোখের সামনে। তা হলে কি …
প্রায় ছুটেই ধাবায় ফেরেন মলয়। ম্যানেজার একটু অবাকই হন সামান্য হাঁফাতে থাকা মলয়কে দেখে।