—তুই তো জানিস, আমি চেষ্টা করছি টাকাটা জোগাড়ের। আর একটু সময় চাই।
—এই কথাটা তো গত দু’মাস ধরে শুনছি। পাঁচ-দশ টাকার ব্যাপার হলে বলতাম না। পাঁচশো টাকা! বাবার থেকে ধার করে দিয়েছিলাম তোকে। শোধ করতে পারবি না জানলে দিতাম না।
—এইভাবে রোজ তাগাদা দিবি জানলে চাইতামও না। চুরি-ডাকাতি না করলে এক ধাক্কায় পাওয়া যায় পাঁচশো টাকা?
—তা হলে চুরি-ডাকাতিই কর! নদীর ধারে বসে জাহাজ গুনলে তো আর টাকা আসবে না!
মাথা গরম হয়ে যায় পঞ্চমের।
—দেব না যা! এক পয়সাও ফেরত দেব না। লেখাপড়া করে তো আর টাকা নিইনি, কোনও প্রমাণ নেই। যা পারিস কর।
—হ্যাঁ, সেটাই করব। টাকা কীভাবে আদায় করতে হয়, আমার জানা আছে। আমার টাকা মেরে দিয়ে কীভাবে চাকরি করিস, দেখব।
—আরে যা যা, মুরোদ থাকলে দেখে নিস যা দেখার!
পঞ্চমের মনে হয়, এতটা মেজাজ গরম না করলেই হত। সত্যিই তো, পাঁচশো টাকা তো কম নয় নেহাত। তবে সে যে চেষ্টা করছে না, এমনও তো নয়। সেটা বুঝবে না? মা-বাবা একসঙ্গে অসুস্থ না হয়ে পড়লে প্রয়োজনও হত না একসঙ্গে অত টাকার। কী করবে এখন? গ্রামের বাড়ির জমিটা বেচে দেবে? বাবা-কাকারা রাজি হবেন?
নদীর ধার থেকে উঠে পড়ে পঞ্চম। হাঁটতে শুরু করে কোয়ার্টারের দিকে। স্ত্রী এবং দুই শিশুপুত্রের জন্য মন কেমন করে ফিরতে ফিরতে। কত দিন দেশের বাড়ি যাওয়া হয়নি। পরের সপ্তাহে সুপারভাইজার সাহেবের কাছে ছুটির দরখাস্ত পেশ করবে স্থির করে ফেলে। কাজে ফাঁকি দেয় না বলে সাহেব পছন্দই করেন তাকে। দেশে গিয়ে জমিজমা বেচার কথাটাও এবার পাড়তে হবে। এভাবে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আর কত দিন?
নামেই ঝিল, জলের থেকে কাদারই প্রাধান্য। গভীর রাতে কিঞ্চিৎ শ্রমসাধ্যই ছিল ঝিলের মাঝামাঝি পুঁতে রাখা দেহ উদ্ধার। ‘দেহ’ লিখলাম বটে, বাস্তবে কঙ্কাল। আক্ষরিক অর্থেই। মাংস নেই কণামাত্র। একটি ধুতি এবং ছেঁড়া শার্ট আলগা লেগে রয়েছে। চোয়ালের নীচের অংশ আর বুকের বাঁ দিকের কিছু হাড় নেই। নেই ডান পায়ের মালাইচাকি (Patella), নেই hyoid bone (ঘাড় থেকে চিবুক পর্যন্ত বিস্তৃত অনেকটা ‘U’ আকারের হাড়, যা জিভের নড়াচড়া ও খাবার গলাধঃকরণে সাহায্য করে)। বেশ বোঝা যায়, জায়গাটি কর্দমাক্ত ছিল বলে পচনপ্রক্রিয়াও (decomposition) ঘটেছে দ্রুততর। শেয়াল-শকুনেও পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে অভাবিত খাদ্যবস্তুর।
মাটি খুঁড়ে পাওয়া পঞ্চম শুক্লার কঙ্কাল
ছেঁড়া শার্টটিতে চারটি বোতাম, পকেটে একটি ছোট লাল পতাকা, সাদা বর্ডারসহ। বন্দরের সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীদের পোশাকে থাকত যে চিহ্ন। পইতেও রয়েছে অক্ষত। রাত ভোর হলে ঝিলটির সর্বত্র তল্লাশি চালিয়ে কাদার মধ্য থেকে মিলল চোয়ালের হাড়। চুন রাখার একটি ছোট কৌটো, যার উপরে হিন্দিতে খোদাই করা, “ওম জয় হিন্দ”। প্রায় ফুটখানেক লম্বা একটি ছুরিও পোঁতা ছিল কাদাতে, উদ্ধার হল। খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র?
পঞ্চম শুক্লা হত্যা মামলা। সাউথ পোর্ট পুলিশ স্টেশনে নথিভুক্ত। তারিখ ২১ মার্চ, ১৯৬০। সে প্রায় ছয় দশক আগের কথা। অভিযোগ খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ এবং হত্যার। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৬৪ এবং ৩০২ ধারা।
এ মামলায়, শুরুতেই লিপিবদ্ধ থাক, রহস্য উদঘাটনের রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ নেই, যা পাঠক সন্ধান করেন গোয়েন্দাকাহিনিতে, সে কাল্পনিক ঘটনাই হোক বা সত্য। নেই একাধিক সন্দেহভাজনের মধ্যে অপরাধীকে চিহ্নিত করার উত্তেজনা।
সমাধানে মেধার ব্যতিক্রমী প্রয়োগ ছিল, এমন দাবি অন্যায্য। অন্যান্য খুনের মামলার তুলনায় কিনারা ছিল সহজসাধ্যই। তবু, কলকাতা পুলিশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এই মামলা এক চিরকালীন মাইলফলক। শুধু কলকাতাই বা লিখি কেন, সারা দেশেই দিকচিহ্ন তদন্ত-গবেষণায়। কারণ?
কারণ নিহিত, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার পার্থক্যে | তদন্তপথের দুটি স্পষ্ট বিভাজন থাকে। একটি অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা পর্যন্ত, তার গ্রেফতারি পর্যন্ত। যে বিন্দুতে সমাপন কাল্পনিক রহস্যকাহিনির। সত্যজিতের ফেলুদাই হন বা শরদিন্দুর ব্যোমকেশ, নীহাররঞ্জনের কিরীটিই হন বা হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত-মানিক, অপরাধটা কে করল এবং কীভাবে করল, তাতেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকে রহস্যপিপাসুর কৌতূহল। না লেখকের, না পাঠকের, দায় থাকে না বিচারপর্বের সাতকাহনের। বাস্তবের গোয়েন্দাদের কাছে, লালবাজারের ফেলু-ব্যোমকেশদের কাছে যার গুরুত্ব অপরিসীম।
কিনারা-পরবর্তী কর্মকাণ্ড শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে পারে অভিযুক্তের। আপাতনীরস এবং রোমাঞ্চবর্জিত এক পথ। অতিক্রম করতে ব্যর্থ হলে নিরর্থক যাবতীয় প্রাক্-কিনারা পরিশ্রম। এই পর্বে উত্তেজনার উপাদান যেহেতু সচরাচর থাকে না তেমন, তদন্তের এই অংশটি সম্পর্কে কাল্পনিক গোয়েন্দাগল্পের নিরাসক্তি সহজবোধ্য। আলোচ্য মামলার বিবরণীতে কিনারা-উত্তর অংশটিই প্রধান উপজীব্য।
রোজ কোয়ার্টারে ফিরে আসেন সন্ধে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে। ১০ মার্চ অন্যথা হল। রাত গড়িয়ে ভোর হল, ভোর গড়িয়ে সকাল, পঞ্চম ফিরলেন না। পঞ্চমের শ্যালকও বন্দরকর্মী ছিলেন। থাকতেন সংলগ্ন কোয়ার্টারেই। খোঁজাখুঁজি এবং উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষার পর সাউথ পোর্ট থানায় মিসিং ডায়েরি নথিভুক্ত হল সে-রাতেই।