পেশ করা হল, এতটুকু অতিশয়োক্তি না করেই লিখছি, ‘সোনায় বাঁধানো’ চার্জশিট। যা খুনের মামলার তদন্তকারীদের কাছে আজও শিক্ষণীয় গ্রাহ্য হয়। আলিপুর দায়রা আদালতের বিচারপর্বে অভিযুক্তের আইনজীবী তর্কের তুফান তুললেন। দাবি, মৃতা আদৌ বেলারানী নন। বেলা অজ্ঞাতপরিচয় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছেন। যে দাবি সর্বৈব মিথ্যায় পর্যবসিত হল ছ’ মাস ধরে চলা সওয়াল-জবাবের চাপানউতোরে। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের নিশ্ছিদ্র বুনন এবং ফরেনসিক পরীক্ষার তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর বীরেনকে ফাঁসির সাজা শোনাল আদালত।
তদন্তকারী অফিসারের চিঠি
রায়ে পরিবর্তন হল না হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টেও। প্রাণদণ্ড বহাল থাকল। ১৯৫৬-র ২৮ জানুয়ারির ভোরে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসিকাঠ দেখা দিল নারকীয় অপরাধের কর্মফল রূপে। কালো কাপড়ে ঢাকল মুখ, গলায় আঁট হয়ে বসল দড়ি, পূর্বনির্দিষ্ট সময়ে বীরেন দত্তের পায়ের তলা থেকে সরে গেল পাটাতন।
Criminology বা অপরাধবিজ্ঞানের জনক বলা হয় ইতালীয় সমাজতাত্ত্বিক Cesare Lombroso (১৮৩৫-১৯০৯)-কে। যিনি বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বকে এক যোগসূত্রে বেঁধে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণে অপরাধীর মনের গহনতম অন্দরে ঢোকার প্রয়াস শুরু করেছিলেন। মূলত সেই আধারেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই বর্তমান সময় পর্যন্ত নিরন্তর জারি রয়েছে অপরাধ-গবেষণা। নিত্যনতুন বিশ্লেষণে অজানা দিগন্তের সন্ধান মিলছে প্রতিনিয়ত।
বেলারানী হত্যা মামলার তত্ত্বতালাশে কেস ডায়েরির হলুদ হয়ে আসা পাতা উলটোতে বসে তবু মনে হয়, কিছু ঘটনা থাকেই, যা গবেষণালব্ধ তথ্যের আজ্ঞাবহ নয়, যা জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যার অতীত। পড়লেন তো। ভাবুন, কোন তত্ত্বের ব্যাখ্যায় ধরা যায় বীরেন দত্ত রচিত নিধননাট্য, সে-যুগে যা পাশবিকতায় কল্পনাতীত এবং নৃশংসতায় নজিরবিহীন?
ত্রিনিদাদের বিশ্ববন্দিত ইতিহাসবিদ C .L. R. James (১৯০১- ৮৯) তাঁর বহুপঠিত বই ‘Beyond a boundary’ (১৯৬৩)-তে লিখেছিলেন, “What do they know of cricket who only cricket know?” যাঁরা শুধু ক্রিকেটই জানেন, তাঁরা আর কতটুকুই বা ক্রিকেট জানেন?
অপরাধীর মনের অন্দরমহলও তা-ই। যতটুকু দেখা যায়, জানা যায়, অদেখা-অজানা থেকে যায় ঢের বেশি। এ এক অন্য পৃথিবী। অন্য ছায়াপথ। যেখানে মনোজগতের আলো-আঁধারি ধোঁয়াশা-কুয়াশা এক বিছানায় শুয়ে থাকে পাশাপাশি।
যেভাবে রচিত হয়েছিল চিন্তাতীত হত্যালীলা, মনে পড়ে যায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমর লাইনদুটি। ব্যঞ্জনা বিস্তৃত বহুদূর, তা ছুঁতে চাওয়ার ধৃষ্টতা নেই। তবু, এ মামলার দলিল-দস্তাবেজ নাড়াচাড়ার সময় কী অমোঘ মনে হয় কবির ওই উচ্চারণ—
“পথের হদিশ পথই জানে, মনের কথা মত্ত
মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।”
১.০৩ অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
[পঞ্চম শুক্লা হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার অনিল ব্যানার্জি]
—রাগের মাথায় করে ফেলেছি স্যার, মাথার ঠিক ছিল না।
—ওটা ধরা পড়ার পর সবাই বলে।
—না স্যার, বিশ্বাস করুন…
—বিশ্বাস-অবিশ্বাস পরে। আগে বল, বডি কোথায়? তাড়াতাড়ি, বেশি সময় নেই হাতে।
—পুঁতে দিয়েছি স্যার।
—কোথায়?
—ঝিলে, কাদার তলায়।
—কোন ঝিল, কোথাকার? পুরোটা বল, না হলে বলানোর হাজারটা উপায় জানা আছে আমাদের।
—বলছি স্যার। তারাতলার কাছে।
—গাড়িতে ওঠ।
আদেশ নির্বিবাদে পালন করেন মধ্যতিরিশের বিহারি যুবক। বন্দর অঞ্চল থেকে গাড়ি যাত্রা শুরু করে গন্তব্যে, তারাতলা।
—ঝিলটা কোথায়?
—বাঁ দিকের রাস্তাটায় ঢুকতে হবে স্যার …
গাড়ি থামল তারাতলা রোড থেকে একটু ভিতরে একটি ঝিলের সংলগ্ন এলাকায়। মধ্যরাত অতিক্রান্ত তখন। রাস্তাঘাট জনমানবহীন, যথেষ্ট আলোকিত নয়। পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন জেরায় বিধ্বস্ত যুবক, টর্চ হাতে অনুসরণে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অফিসাররা। অসময়ের বর্ষণে কর্দমাক্ত পথঘাট। উর্দিধারীদের পায়ে গামবুট, আবশ্যিক সাবধানতাস্বরূপ।
বডি ওইখানে স্যার, পোঁতা আছে। ভেবেছিলাম, কেউ খুঁজে পাবে না কখনও।
বডি? বডি আর কই? পচেগলে কঙ্কাল, কী-ই বা অবশিষ্ট আর?
একে একে পণ্যবাহী জাহাজ এসে নোঙর ফেলছে খিদিরপুর ডকে। হুগলি নদীর বুকে ভাসমান সার দিয়ে, নিত্যদিনের নিয়মে। পণ্যসামগ্রী যে কত, কত বিচিত্র আকার-আয়তনের যে বাক্স শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে, দেখে তাক লেগে যায় পঞ্চমের। পরিচিত দৃশ্যপট, তবু রোজই ভাবে, এত মালপত্র কোথা থেকে আসে, কারা পাঠায়? ডিউটির পর নদীর ধারে চুপচাপ কিছুটা সময় কাটানো প্রাত্যহিক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তার। বন্ধুরা ঠাট্টা করে, একই জিনিস, জাহাজ আসছে, মাল খালাস হচ্ছে। রোজ কী এত দেখিস?
পঞ্চম নিরুত্তর থাকে। উত্তরটা তার নিজেরও অজানা। কলকাতা বন্দরে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীর চাকরিটা যখন পেয়েছিল বেশ কয়েকবছর আগে, সুদূর উত্তর ভারত থেকে পাড়ি দিয়েছিল অজানা-অচেনা বঙ্গদেশে, কখনও ভাবেনি জায়গাটা এত ভাল লেগে যাবে। সব ভাল লাগা ব্যাখ্যা করা যায়?
আজ অবশ্য মনটা ভারী হয়ে আছে। একটু আগে ঝগড়া হয়ে গেল বন্ধুর সঙ্গে।
—আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না পঞ্চম। খুব বেশি হলে আর এক সপ্তাহ সময় দিতে পারি। তার বেশি কিছুতেই নয়।