বিবেকবর্জিত দুশ্চরিত্র ছিলেন বীরেন, ঠিকই। কিন্তু সত্যের স্বার্থে স্বীকার্য, গুণও ছিল কিছু। ছোট থেকেই পাড়ায় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন এবং নেহাত মন্দ করতেন না। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয় যাতায়াত ছিল নিয়মিত। সেখানেই আলাপ-পরিচয় প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে। একটা-দুটো নয়, অভিনয় করেছিলেন ছ’টি ছবিতে। যার মধ্যে বাঙালির সর্বকালীন মহানায়কের কেরিয়ারের দ্বিতীয় মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘কামনা’-ও ছিল। বাকি ছবিগুলি ‘নারী’, ‘মহাকাল’, ‘শুভদা’, ‘নিষ্কৃতি’ এবং ‘পাপের পথে’।
‘পাপের পথে’ আক্ষরিক অর্থেই পা বাড়ানো অবশ্য ওই স্টুডিয়োপাড়া থেকেই। জুটে গেল কিছু ইয়ারদোস্ত। রেসের মাঠ, জুয়ার ঠেক আর নিষিদ্ধ পল্লির ত্র্যহস্পর্শে দিশা হারালেন। ফার্মাসির কাজকর্মে মন দিতেন না আর। কর্মচারীদের উপর ছেড়ে দিলেন পুরোটাই। ফল, বাণিজ্যলক্ষ্মী বিরূপ হলেন, শুরু হল অর্থসংকট। এমনিতেই দুটো সংসার চালানো যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। কষ্টেসৃষ্টে তবু চলছিল। কিন্তু বীরেন চোখে অন্ধকার দেখলেন, যখন জানলেন, বেলা দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তানসম্ভবা।
—এর পর?
—আমি আর পারছিলাম না স্যার। একে ব্যবসায় মন্দা চলছে। অনেক ধারদেনা হয়ে গিয়েছিল। তার উপর বেলা আর মীরাকে মিথ্যে বলে বলে ক্লান্ত। ভয় হত স্যার, যে-কোনও দিন ধরা পড়ে যাব। মীরা তো সন্দেহ করতে শুরু করেইছিল, বেলাও মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করত, রোজ রাত্রে কীসের এত কাজ? যখন শুনলাম, বেলা আবার মা হতে চলেছে, প্রথমেই মাথায় এল, আবার একগাদা খরচের ধাক্কা। ঠিক করলাম, বেলাকে সরিয়ে দেব। আর কোনও উপায় ছিল না স্যার, বিশ্বাস করুন!
বিশ্বাস-অবিশ্বাস পরে। জিজ্ঞাসাবাদের গোড়ার কথা, খুব বেশি বিরাম দিতে নেই স্বীকারোক্তির সময়। গোয়েন্দারা থামতে দিলেনও না। বীরেন বলে চললেন।
—এক চোট রাগারাগি করলাম প্রথমে। বললাম, এ সন্তান আমার নয়, হতে পারে না। আমার রাতে বাইরে থাকার সুযোগ নিয়েছ তুমি। শুনে বেলা প্রথমে কাঁদল, তারপর ঝগড়াঝাঁটি হল খুব।
খুনের পরিকল্পনায় একমাত্র পথের কাঁটা ছিল পুত্র বোতন, বয়স তখন ছয়। কী করা যায়? মীরার কাছে আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদলেন বীরেন। বললেন, এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন পথদুর্ঘটনায়। রেখে গিয়েছেন ছ’বছরের ছেলেকে, যে এখন সর্বার্থেই অনাথ। মীরা রাজি থাকলে হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে রাখতে চান। মীরা আবেগপ্রবণ স্বভাবের ছিলেন, সম্মতি দিলেন এক কথায়।
২৭ জানুয়ারি, ১৯৫৪। বেলা তখন পূর্ণ সন্তানসম্ভবা। ফার্মাসি থেকে বাড়ি ফিরলেন বীরেন। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। বোতন ঘুমোচ্ছে অকাতরে। বেলা রুটি-আলুভাজা সাজিয়ে দিলেন থালায়। বীরেন নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলেন। এবং করেই গালিগালাজ শুরু করলেন বেলাকে, আমি এক পয়সাও খরচ সেই বাচ্চার জন্য করব না, যে আমার নয়। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল বেলার, মেজাজ হারালেন, তোমার কীর্তিকলাপ জানতেও আর বাকি নেই কারও।
বীরেন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। বেমক্কা মারধর শুরু করলেন। রান্নাঘরে রাখা দা দিয়ে বেলার ঘাড়ে কোপ বসালেন। বেশ কয়েকবার। অবিরাম রক্তক্ষরণ এবং মৃত্যু কিছুক্ষণের মধ্যেই। কাঠের আলমারিতে কাপড়চোপড় ছিল। সেসব বার করে আলমারিতেই ঢুকিয়ে দিলেন মৃতদেহ। ধুয়েমুছে পরিষ্কার করলেন রক্তস্রোত। তার আগে বেলার শরীরে যা গয়নাগাটি ছিল, খুলে নিলেন সব। ছ’জোড়া সোনার চুড়ি, সোনার আংটি, কানের দুল, সব। এবং, এত কিছুর পর, ঘুমিয়ে পড়লেন নিশ্চিন্তে!
খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র
উদ্ধার করা বেলারানীর বালা
টার্ফ রোডের বাড়ির দু’তলায় একাই থাকতেন বেণু নামের এক অবিবাহিতা মহিলা। যাঁর সঙ্গে বেলার ঘনিষ্ঠতা ছিল, যিনি অসম্ভব ভালবাসতেন বোতনকে। বোতন দিনের অনেকটা সময় কাটাত ‘বেণুমাসি’র সঙ্গে। ২৮ তারিখ ভোরে উঠেই পরের ধাপগুলো ছকে নিলেন বীরেন। কীরকম?
—ভোরে উঠে বেণুদিকে ডাকলাম। বললাম, গভীর রাতে বেলাকে ভরতি করাতে হয়েছে শিশুমঙ্গল হাসপাতালে। ডেলিভারি হবে যে-কোনও সময়। বোতনকে এ ক’দিন যদি বেণুদি নিজের কাছে রাখেন, ভাল হয়। বেণুদি সানন্দে রাজি হলেন। বোতন সকালে উঠে জানতে চাইল, মা কোথায়? বললাম, মা হাসপাতালে গিয়েছে, তোমার একটা ভাই বা বোন নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।
অচিন্তনীয়! বেলার লাশকে আলমারিবন্দি রেখে দিব্যি সকালে দোকানে বেরলেন বীরেন। ভাবতে থাকলেন সারাদিন, লাশ হাপিস করা যায় কীভাবে? লাশই যদি না পায় পুলিশ, কাকেই বা ধরবে, কীভাবেই বা ধরবে? রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ কর্মচারীরা বেরিয়ে গেল, দোকানে জমিয়ে রাখা ‘যুগান্তর’-এর স্তূপ থেকে কয়েকটা বার করে নিলেন বীরেন। রওনা দিলেন টার্ফ রোড। পরের অংশ বীরেনের বয়ানেই পড়ুন, নিস্পৃহ বিবরণ দুঃসাধ্য।
—বেলার বডি বার করলাম আলমারি থেকে। প্রথমে দা দিয়ে মাথাটা কাটলাম। তারপর এক এক করে কান-নাক-চুল-হাত-পা-বুক-পেট, সব। মুখের চামড়া চেঁছে দিলাম। যুগান্তরের পাতা দিয়ে মুড়ে নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দিলাম আলমারিতে। তালাও লাগিয়ে দিলাম। পুরো ঘরটা দু’-তিনবার ধুলাম ফিনাইল দিয়ে। রক্তে থইথই করছিল তো, গন্ধও বেরচ্ছিল খুব।