.
এলাকা দখলে। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ফুলে ঢোল। পুলিশি রেইড থেকে বাঁচার নিরাপত্তা বলয় আরও নিশ্ছিদ্র। এর পরের ধাপে যা হয়ে থাকে সাধারণত, সেটাই ঘটল শ্যামলের ক্ষেত্রেও। প্রোমোটারির অন্দরমহলে পা রাখা। বালি-উত্তরপাড়া-রিষড়া-কোন্নগরে প্রচুর আবাসন তৈরি হচ্ছে তখন। যেখানে যা জমি খালি পড়ে ছিল, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। টাকা উড়ছে, শুধু লুফে নিতে হবে। শ্যামল ঠিক করল, খুনখারাপি-ঝামেলা অনেক হয়েছে। এবার ‘ডন’ থেকে ‘ব্যবসায়ী’ হওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে লাখ পেরিয়ে কোটিতে খেলার।
প্রথম জমিটা দখল নেওয়ার সময় ‘দাদাগিরি’ অবশ্য করতেই হল। একটা প্লট পছন্দ হয়েছিল শ্যামল-রমেশের। কিনে ফ্ল্যাট বানিয়ে চড়া দরে বেচলে প্রচুর মুনাফা। কিন্তু যে দর ‘অফার’ করল শ্যামল, তাতে রাজি হচ্ছিলেন না জমির মালিক। বললেন, ‘তোমরা জলের দরে চাইছ জমিটা। এ হয় না। আমি এর চেয়ে অনেক বেশি দাম পাব কাগজে বিজ্ঞাপন দিলে।’ শ্যামল সোজা পিস্তল বের করে পেটে ঠেকিয়ে দিল, ‘বেঁচে থাকলে তবে তো কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন। হয় জমিটা দিন, নয়তো মরে যান। আপনার চয়েস।’ বেঁচে থাকাকেই বেছে নিলেন জমির মালিক। শ্যামলের প্রথম প্রজেক্টে ইট-বালি-সিমেন্ট পড়তে শুরু করল।
সেই শুরু, এবং বছরখানেকের মধ্যেই এলাকার প্রোমোটিংয়ে মৌরসিপাট্টা কায়েম করে নেওয়া। এখানেও নিয়ম বাঁধা। কোনও একটা জমিতে হয়তো কেউ ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। প্রতি স্কোয়ারফুট পিছু ৫০ থেকে ৭০ টাকা বরাদ্দ থাকবে শ্যামলের জন্য। কারও দখলে হয়তো কোনও জমি আছে, কিন্তু জি প্লাস থ্রি বানানোর পয়সা নেই। শ্যামল টাকার জোগান দিত। শর্ত, মাসে তিন শতাংশ সুদ। লোকেশন যদি খুব ভাল হয়, সুদের হার বেড়ে পাঁচ শতাংশ। এর উপর স্কোয়ারফুট পিছু ৫০ থেকে ৭০ টাকা তো রইলই।
আরও ছিল। ফ্ল্যাট কেউ শ্যামলের দেওয়া টাকাতেই বানাক বা নিজের পয়সায়, ইট-বালি-সিমেন্ট কিনতে হবে শ্যামলের এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দোকান থেকে। যার ইমারতি সামগ্রীর ব্যবসা। স্কোয়ারফুটের মাপজোক যাতে ঠিকঠাক হয়, তার জন্য মাসমাইনের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করেছিল শ্যামল। ইঞ্জিনিয়ার সাইটে গিয়ে সব দেখেটেখে এসে রিপোর্ট দিলে তবেই শুরু হত টাকাপয়সার গল্প। হিসেবপত্রের জন্য অবশ্য মাইনে দিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখার দরকার পড়েনি। শ্যামল নিজেই রাখত প্রতিটা পাইপয়সার হিসেব। একটা খাতায় যেভাবে লিখে রাখত পাওনাগন্ডার খুঁটিনাটি, দেখলে কে বলবে ক্লাস থ্রি-তেই পড়াশোনায় ফুলস্টপ!
টাকা আসতে লাগল বন্যার স্রোতের মতো। খুব নিম্নবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা কোনও সমাজবিরোধী যখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে পড়ে, চোখে ঝিলমিল লেগে যায়। সমাজের উচ্চকোটির জীবনযাত্রাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেখে দেখার একটা মোহ তৈরি হয়। শ্যামল ব্যতিক্রম ছিল না। বিলাসবহুল গাড়িতে যাতায়াত বাড়ল শহরে। একাধিক ফ্ল্যাট ভাড়া নিল কলকাতায়। ভাড়া অবশ্য নিত খুব অল্পদিনের জন্য। তারপর ছেড়ে দিয়ে ফের অন্য এলাকায় অন্য ফ্ল্যাট। খুব ঘনিষ্ঠ দু’-একজন ছাড়া কেউ জানত না ফ্ল্যাটগুলোর ঠিকানা । যেখানে মাঝেমাঝে খানাপিনা নাচাগানার আসর বসাত শ্যামল। এক রাতের সুর আর সুরার আয়োজনে উড়ে যেত লক্ষ লক্ষ টাকা!
লাইফস্টাইলে আমূল পরিবর্তন হল। সেরা ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক গায়ে উঠতে লাগল রোজ। নিজের কুর্তা-পাজামা অর্ডার দিয়ে বানাতে শুরু করল কলকাতার সেরা ডিজ়াইনারদের দিয়ে। সঙ্গে যোগ হল যথেচ্ছ নারীসংসর্গের অভ্যেস, যেটা আগে ছিল না। প্রচুর টাকার বিনিময়ে টলিউড এমনকী বলিউডের নায়িকাদের সঙ্গে সময় কাটানো যায় কিনা, সেই খোঁজ করার জন্য মোটা টাকা দিয়ে এজেন্ট লাগিয়েছিল। বড়াই করে বন্ধুদের বলত, ‘আমার পড়াশুনো হয়নি বলে তোরা ঠাট্টা করিস… তোরা তো কেউ বারো ক্লাস, কেউ গ্র্যাজুয়েট, পারবি টপ হিরোইনের সঙ্গে পাঁচতারা হোটেলে সময় কাটাতে?’
দুই মেয়ে ছিল শ্যামলের। যাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসত। মেয়েদের ভরতি করেছিল কলকাতার অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। বলত, ‘আমার তো বাওয়াল করেই লাইফটা খরচা হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েগুলো ইংলিশে কথা বলবে, ফরেন যাবে পড়তে, মিলিয়ে নিবি।’ পাশাপাশি আক্ষেপও করত, ‘মেয়েদুটোর তো বিয়ে হয়ে যাবে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমার টাকাপয়সা আর ব্যবসার দেখভাল কে করবে? একটা যদি ছেলে থাকত!’ ছেলের আশাতেই শ্যামল দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। মিতালি নামের এক তরুণীকে। তবে প্রথম স্ত্রী তাপসীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেনি বিশেষ।
চিড় বরং ধরেছিল শ্যামল-রমেশের সমীকরণে। নাম্বার ওয়ান আর নাম্বার টু-র মতবিরোধে গ্যাংয়ের মধ্যে চাপা টেনশন জন্ম নিচ্ছিল। শ্যামলের মনোভাব ছিল, অনেক তো হল। এবার পুরো ফোকাসটা সিন্ডিকেট ব্যবসায় দেওয়া যাক। ‘চমকানো-ধমকানো’র মেশিনারি তো আছেই, থাকবেও। কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আর নিজেরা সরাসরি ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেই পুলিশের অনেক কেসে নাম ঝুলছে। আর বাড়িয়ে কী লাভ? বরং বুদ্ধিমানের কাজ হল, একটা আপাত-ভদ্র ‘ইমেজ’ তৈরি করা। যাতে পরের বার মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে দাঁড়ানো যায়। রাজনীতির একটা মোড়ক থাকলে কিছুটা সুবিধে তো পাওয়াই যায়।