শ্যামল হাসল, ‘এই জন্যই আমি আমার জায়গায়, আর তোরা তোদের জায়গায়। থানার জিপগুলো বেশিরভাগই দেখবি লজ্ঝড়ে। যত্ন নেই। তার উপর হেবি রাফ চালায়। তাই দেখবি হেডলাইটের পজিশন ঠিক থাকে না। উঁচুনিচু হয়ে যায়। অন্য গাড়িতে আলো সোজা রাস্তায় পড়ে। পুলিশের গাড়িতে দেখবি হেডলাইটের আলোটা একটু উপরে পড়ে। ইলেকট্রিকের তারে ঝিলিক মারে। আমি তারে ওই আলোর ঝিলিকটা দেখলাম। মানে পুলিশ।’
মোবাইলের যুগে যে টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে অবস্থান জেনে নেওয়া যায়, বছরের পর বছর চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে জেনে গিয়েছিল শ্যামল। জেনে গিয়েছিল, পুলিশ ফোনে আড়িও পাততে পারে নম্বর জানা থাকলেই। সেই প্রযুক্তি এসে গেছে। চূড়ান্ত সতর্ক থাকত ফোন নিয়ে। অন্তত হাফ ডজন মোবাইল সঙ্গে থাকত অষ্টপ্রহর। নিজের কাছে দুটো। বাকিগুলো সর্বক্ষণের সঙ্গীদের কাছে। পালটে পালটে ব্যবহার করত প্রত্যেকটা ফোন। একটা ফোন টানা দু’ঘণ্টার বেশি চালু রাখত না কখনওই। কোন ফোনটা যে কখন চলবে, কোনটা যে কখন বন্ধ হবে হঠাৎ, কখন যে ফের চালু হবে, কেউ জানত না। সবসময় মাথায় রাখত, হয়তো নম্বরগুলো জেনে গেছে পুলিশ। হয়তো প্ল্যান করছে রেইড-এর। হয়তো আড়ি পেতে শুনছে কথাবার্তা। শ্যামল তাই ফোনে কথা বলতও কম। আর বলার সময়ও এমন কিছু কথা ভাসিয়ে দিত ইচ্ছে করে, যাতে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়। হয়তো আছে কোন্নগরে, রাতে কোনও একটা ‘অপারেশন’ করার কথা আছে রিষড়ায়। একটা ফোনে কাউকে বলল, ‘রাতে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির সামনে চলে আয়। বাকি কথা ওখানে হবে।’ সঙ্গীরা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে ক্রুর হাসত শ্যামল, ‘একটু চুক্কি দিলাম আর কী! পুলিশ জাতটাকে বিশ্বাস নেই। যা বলছি, শুনছে হয়তো। শুনলে শোন না… যা ঘুরে মর হাওড়ায়। আমি এদিকে কাজটা সেরে নিই। নো রিক্স।’
রিস্ক নিত না, এমন নয়। নিত, কিন্তু ভেবেচিন্তে। বাঘার সঙ্গে যখন সেয়ানে-সেয়ানে চলছে কোন্নগর-কানাইপুরে, একদিন দুপুরবেলা শ্যামল একা বাইক চালিয়ে বারুজীবী কলোনিতে ঢুকল। ঢুকল কানাইপুরের দিক থেকে। যেটা বাঘার এলাকা। রমেশ জিজ্ঞেস করল, ‘এই রাস্তা দিয়ে এলি যে? এই ঝুঁকি নেয় কেউ? আর রাস্তা ছিল না? বাঘার এরিয়া দিয়েই আসতে হল? যদি বাঘার ছেলেরা দেখতে পেয়ে যেত? যদি ঘিরে নিত?’
শ্যামলের উত্তর সোজাসাপ্টা, ‘আরে তোরাও যেমন! বাঘার পাড়া দিয়ে ঢোকাই তো সবচেয়ে সেফ রে! ওরা যদি আমাকে দেখেও ফেলত, ভাবতেও পারত না যে আমি একা ঢুকেছি। ভাবত, আশেপাশে ছেলে আছে অনেক। অ্যাটাক করতে এসেছি বোধহয়। ভয় পেয়ে যেত। বাঘাকে খবর দিত। গুলি-বোমা নিয়ে রেডি হতে ওদের সময় লাগত কিছুটা। তার মধ্যে এই দ্যাখ আমি আরামসে নিজের মহল্লায়। যাতায়াতের সময় রুট বদলাবি মাঝে মাঝে। একই রুটে গেলে ডেঞ্জার বেশি। নে নে… ঢাল একটা…।’
ফোনই শুধু ঘনঘন বদলাত না, বদলাত চেহারাও। কখনও শুধুই গোঁফ রাখত। কখনও গোঁফের সঙ্গে একমুখ দাড়ি। এবং তার উপর পাগড়ি চড়িয়ে পাক্কা পাঞ্জাবি। কখনও আবার গোঁফদাড়ি উড়িয়ে দিয়ে পরিপাটি ক্লিনশেভন। দূরপাল্লার ট্রেনে প্যাসেঞ্জার সেজে উঠে রেলডাকাতি করত যখন কেরিয়ারের শুরুর দিকে, তখন থেকেই ছদ্মবেশ ধরায় পটু। কখনও বিহারি সাজত, কখনও পাঞ্জাবি। সেই অনুযায়ী পোশাক-আশাক। চেহারার ছিরিছাঁদ পালটানোর এই অভ্যেস আগাগোড়া বজায় রেখেছিল শ্যামল। ঠিক এই মুহূর্তের মুখের চেহারাটা কেমন, রেইড করার সময় জানত না পুলিশ। দীর্ঘদিন অ্যারেস্ট না হওয়ায় সাম্প্রতিক কোনও ছবি ছিল না শ্যামলের। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া সঙ্গীদের থেকে চেহারার বিবরণ শুনে এবং সোর্সদের সঙ্গে কথা বলে একটা ধারণাই তৈরি ছিল শুধু।
নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনার চেষ্টা করত সবসময়। বাইক চালাত দুর্দান্ত। কেউ কখনও অন্যের বাইকের পিছনে বসতে দেখেনি। সে যতই নেশা হোক, ‘পিলিয়ন রাইডিং’ কখনও নয়। বলত, ‘অন্য কেউ শালা কোথায় কখন গাড়ি ভিড়িয়ে দেবে, ঠিক আছে কোনও?’
গুলি-বোমার ব্যাপারেও একই নীতি। এক শাগরেদের ভাষায়, শ্যামল লোহা আর ছিলামে দানা নিজে ভরত। হজমোলা নিজেই বানাত। ডেটলেও অন্য কাউকে হাত দিতে দিত না। বলত, ‘নিজের মাল নিজে রেডি করব। অন্যের বানানো মাল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেই যদি ফুটে যাই?’
অন্ধকার জগতের ভাষা এগুলো। ‘লোহা’ মানে দেশি পিস্তল। মুঙ্গেরে বানানো পিস্তল, যার ম্যাগাজিন আছে গুলি ভরার, তার নাম ‘ছিলাম’। ‘দানা’ কী, পাঠক হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন। গুলি। ‘ডেটল’ মানে বোম বানাতে যে নাইট্রোগ্লিসারিন লাগে। আর ‘হজমোলা’? শিশি বোমার কোডনেম।
সব বিষয়ে অবশ্য শ্যামল এতটা স্বাবলম্বী ছিল না। ব্যাঙ্কের চেকবইয়ে সই করা যেমন। শ্যামলের একেবারে ছোটবেলার এক বন্ধুর কথায়, ‘যখন প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলল, সে এক কাণ্ড! ইংরেজি অক্ষর লিখতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা। ‘এস’ আর ‘এইচ’ লিখতেই আধঘণ্টা কাটিয়ে দিল। শেষে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, এর থেকে তো ক্ষুর দিয়ে লেখা সোজা ছিল। ঘণ্টাদেড়েকের কসরতের পর কোনওভাবে সই করল চেকে। আর মকশোর কাগজটা রেখে দিল ওয়ালেটে। ওটা সবসময় সঙ্গে রাখত। বলত, ‘না দেখে নিজের নাম ইংরেজিতে লেখা? পারবই না!’