হাইকোর্টে সাজা মকুবের আবেদন জানিয়েছিল সজলরা। এক বছরের আইনি চাপানউতোরের পর হাইকোর্ট সজল আর রঞ্জিতকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। বরাদ্দ হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাস। বাকি পাঁচ অভিযুক্তের কারাবাসের মেয়াদও কমেছিল। যাবজ্জীবন থেকে কমে কারও তিন বছর, কারও পাঁচ, কারও বা সাত।
.
শুরুর কয়েক বছর সজল ছিল দমদম সংশোধনাগারে। তারপর তাকে স্থানান্তরিত করা হয় মেদিনীপুরের সংশোধনাগারে। যেখানে সজল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বলে, পেটে প্রবল ব্যথা হচ্ছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় কিডনির সামান্য সমস্যা ধরা পড়ে। নিয়ে আসা হয় কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। সেটা ২০০১-এর সেপ্টেম্বর। চিকিৎসাধীন থাকাকালীন এক রাতে প্ৰহরারত দুই কনস্টেবলকে বোকা বানিয়ে হাসপাতাল থেকে চম্পট দেয় সজল। ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত সে ছিল পলাতক। বহু চেষ্টাতেও সন্ধান পায়নি পুলিশ।
‘ফেরার’ থাকার এই প্রায় দেড়টা বছর কীভাবে কাটিয়েছিল সজল? হাসপাতাল থেকে পালানোর পর সজল পাড়ি দিয়েছিল মুম্বই। সেখানে টুকটাক ক্রাইম করেই হত দিন-গুজরান। মুম্বইতেই সেরে ফেলেছিল বিয়েটা। মেয়ে হয়েছিল বছরখানেক পর।
২০০২-এর শেষের দিকে কলকাতায় ফেরে সজল। মুম্বইয়ে বড্ড খরচ, পোষাচ্ছিল না আর। লেকটাউন এলাকার এক দাগি দুষ্কৃতীর দলে ভিড়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। হাত পাকানো শুরু করে তোলাবাজিতে। স্রেফ খুচরো তোলাবাজিতে বেশিদিন অবশ্য সন্তুষ্ট থাকতে চায়নি সজল। আর সেটাই কাল হয়েছিল। সিবিআই অফিসার সেজে সল্টলেকের একটা বাড়িতে ঢুকে ডাকাতি করল ২০০৩-এর জানুয়ারিতে। সেই মামলাতেই সপ্তাহদুয়েকের মধ্যেই নাম উঠে এল জনৈক শেখ কালামের। সোর্স মারফত খবর পেয়ে এই কালামকে ধরল পুলিশ। এবং ধরামাত্রই চেহারা দেখে বুঝতে পারল, শেখ কালামটা ভুয়ো নাম। এ সজল। প্রায় দেড় বছর ধরে ফেরার সজল বারুই!
এরপর? ফের দীর্ঘ কারাবাস। ‘দ্য জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন) অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ২০১০ সালে সজলের আইনজীবী আদালতে জামিনের আর্জি জানালেন। বললেন, সজলের কারাবাসের ষোলো বছর অতিক্রান্ত। কিশোর বয়সে জড়িয়ে পড়েছিল অপরাধে। নিজেকে সংশোধনের একটা আইনানুগ সুযোগ প্রাপ্য বর্তমানে তেত্রিশ বছরের সজলের। আবেদন মঞ্জুর করেছিল হাইকোর্ট। ২০১০ সালের ১০ অগস্ট জামিনে জেলের বাইরে পা রেখেছিল সজল।
নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ পেয়েছিল সজল। তবে ব্যবহার করেনি সে সুযোগ। ২০১১-য় যোধপুর পার্কের এক গেস্ট হাউসে দেড় লক্ষ টাকার ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। দ্রুতই ঘটনার কিনারা করেছিল লালবাজার। দু’জন ধরা পড়েছিল। যারা কবুলও করেছিল অপরাধ, এবং যাদের জেরায় জানা গিয়েছিল, বিকাশ নামে একজন এই ডাকাতির মাস্টারমাইন্ড। পুরো ছকটা বিকাশেরই। ধৃতদের থেকে চেহারার বর্ণনা শুনে আঁকানো হয়েছিল স্কেচ। যে স্কেচ দেখে ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল ডাকাতি-দমন শাখার ওসি-র। আরে, এই ছবিটার সঙ্গে সেই ছেলেটার ছোটবেলার মুখচোখ আর ফিচার্স অনেকটা মিলে যাচ্ছে না? সেই ছেলেটা, যে নাইন্টি থ্রি-তে দমদমে নিজের বাবা-সৎমা-সৎভাইকে খুন করেছিল বন্ধুদের সঙ্গে মিলে?
ক্রাইম রেকর্ডস সেকশন থেকে সজল বারুইয়ের ছবি এনে দেখানো হয়েছিল ধৃতদের। যারা ছবি দেখেই চিনেছিল, ‘এটা বিকাশেরই ছোটবেলার ছবি… হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিকাশ!’ মিলে গিয়েছিল ওসি-র আন্দাজ, ‘যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। শরীরে একটু মাংস লেগেছে, কিন্তু বাকি চেহারাটা এতদিনেও বিশেষ পালটায়নি। বিকাশটা ভুয়ো নাম। এটা মোস্ট ডেফিনিটলি সজল। সজল বারুই।’
এই ডাকাতির মামলায় বেশ কয়েক বছর জেল খাটার পর সজল মুক্তি পেয়েছিল ২০১৭-য়। তারপর থেকে বাইরেই আছে। নতুন কোনও অপরাধে তার নাম এখনও পর্যন্ত জড়ায়নি। ষোলো বছর বয়সে যে অভাবনীয় কাণ্ড সে ঘটিয়েছিল, তাতে আজ এই প্রায় তিন দশক পরেও ‘সজল বারুই’ পরিচয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভবই। অন্য কোনও নামে, অন্য কোনও পরিচয়ে নিজের মতো করে হয়তো চেষ্টা করছে সুস্থ জীবনে ফিরতে। ভাল হলেই ভাল।
.
অপরাধ-মনস্তত্ত্বের কত যে রসদ মজুত এই মামলায়! ভাবলে অবাক লাগে, সজল বারুইয়ের না হয় যথেষ্ট কারণ ছিল সুবল-নিয়তি-কাজলের সঙ্গে ‘হিসেব’ মিটিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাকি বন্ধুদের? শুভ্রশীল-অলোক-রঞ্জিত-দেবাশিষ-সমরের? ওদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর হয়েছিল প্রচুর। লেখালেখিও হয়েছিল অনেক। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর স্কুলপড়ুয়া সব। কোনও শারীরিক-মানসিক সংকট আপাতদৃষ্টিতে নেই যাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকায়। তবু রাজি হয়ে গেল ষড়যন্ত্রে, তিনটে জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলার পরিকল্পনায়? শুধুই বন্ধুর প্রতি ভালবাসায় হয় এটা? সম্ভব? নাকি অপরাধপ্রবণতার অঙ্কুর নিজেদের অজান্তেই ওদের কিশোরমনেও ঘাঁটি গেড়েছিল কোনও কারণে?
উত্তর মেলে না। বিদগ্ধ গবেষণায় বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় মানবমনের সব গহনের, সব দহনের হদিশ মিললে তো হয়েই যেত। হয়েই যেত মনের পাসওয়ার্ড ‘হ্যাক’ করা।
সেটা হয় না বলেই না মন! মনের চলাচলের উপর কে আর কবে প্রভুত্ব করতে পারে? মনই কি কখনও পায় মনের সম্পূর্ণ মালিকানা?