ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন একঝাঁক আইপিএস। উত্তর ২৪ পরগনার এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ), আইজি (দক্ষিণবঙ্গ), ডিআইজি (সিআইডি)। কেসের তদন্তভার বর্তাল সিআইডি-র ওপর।
তবে সত্যি বলতে সজল যে আষাঢ়ে গল্পটা বানিয়েছিল, তাতে তদন্তকারীদের কাজটা নেহাতই সহজ হয়ে গিয়েছিল। সজল এক দুর্ধর্ষ ডাকাতদলের গল্প ফেঁদেছিল। সাতজন ঢুকেছিল। যাদের মধ্যে দু’জন প্রকাণ্ড চেহারার পাঞ্জাবি। সাতজনই হিন্দিতে কথা বলছিল। ওই দুই পাঞ্জাবি সহ সাতজনেরই মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা ছিল। সুবল-নিয়তি-কাজলকে মেরে ফেলার পর ওরা সজলকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রেখে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তার মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে খুব জোরে মারে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরের দিন দুপুরের দিকে জ্ঞান ফিরলে সে দরজায় ধাক্কা দেওয়া শুরু করে। চিৎকার করতে শুরু করে।
এ গল্প ক্লাস ফাইভের বাচ্চাই বিশ্বাস করবে না, তো পুলিশ! কয়েকটা মাত্র প্রশ্ন করা হল সজলকে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দরজা ভিতর থেকে লক করলে কী করে? তা ছাড়া তুমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে, তা হলে কে লক করল? ডাকাতরা কুপিয়ে মারল দু’জনকে। গলা টিপে খুন করল আরেকজনকে। তোমার গায়ে আঁচড়টুকুও পড়ল না। এতই নরমসরম ভাবে তোমাকে বেঁধে রেখে গেল, যে ইচ্ছে করলেই তুমি দরজা লক করতে পারতে। শুধু তোমারই প্রতি এত মায়াদয়া কেন ডাকাতদের? তা ছাড়া ডাকাতি করার পর অস্ত্রশস্ত্র এত পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখে গেছে ডাকাতরা, এটাই বা কে কবে শুনেছে?
একটা প্রশ্নেরও সদুত্তর ছিল না সজলের কাছে। প্রথম দু’দিন শোকগ্রস্ত থাকার অভিনয় করে কাটাল। বয়ান বদলাল একাধিকবার। কিন্তু ওই আজগুবি গপ্পো আর সিআইডি অফিসারদের কাছে কতক্ষণ টিকবে? টিকলও না। তৃতীয় দিনেই এল স্বীকারোক্তি। সব খুলে বলল সজল।
শুভ্রশীল রায়, ডাকনাম রাজা। সমর সাহা ওরফে বুড়ো। অলোক সাহা, ডাকনাম টোটো। দেবাশিষ দে আর রঞ্জিত মণ্ডল। সবাই নাবালক। বয়স ওই ষোলো-সতেরোর মধ্যে। স্কুলপড়ুয়া সবাই। রাজা-বুড়ো-টোটো-দেবাশিষকে ধরতে এতটুকুও বেগ পেতে হল না পুলিশকে। রঞ্জিত ছিল বর্ধমানে এক আত্মীয়ের বাড়ি। তুলে আনা হল। ছুরি-ভোজালি রঞ্জিতই মধ্য কলকাতার একটি দোকান থেকে জোগাড় করেছিল এক পরিচিতের মাধ্যমে।
ষোলো বছরের এক কিশোর তারই সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে কীভাবে ছক কষেছিল বাবা-সৎমা-সৎদাদাকে হত্যার, খুনের পরে তিনটে লাশের সঙ্গে কী অবলীলায় রাত কাটিয়েছিল নির্বিকার, প্রকাশ্যে এল সব। আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) প্রেসকে বললেন, ‘The brutality is difficult to digest even for hard-boiled cops like us.’
মামলার বিবরণ কাগজে প্রকাশিত হচ্ছিল রোজ। বেরচ্ছিল মনোবিদদের নিবন্ধ। বাসে-ট্রামে-মাঠে-ঘাটে-রকের আড্ডায় তখন একটাই আলোচনা। সজল বারুই। ঘটনার ভয়াবহতায় আমূল নড়ে গিয়েছিল কলকাতা সহ পুরো রাজ্যই। বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা নিয়ে রাতারাতি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন অভিভাবকরা।
একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন এবং প্রমাণ লোপাট। এই ছিল মামলার ধারা। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে বিশেষ কাঠখড় পোহাতে হয়নি তদন্তপর্বে। গয়নাগাটি সবই উদ্ধার হল অভিযুক্তদের কারও না কারও বাড়ি থেকে। গয়নাগুলো যে তাদের বাড়িরই, চিহ্নিত করল খোদ সজলই। একটা পলিথিনের প্যাকেটে গ্লাভস আর কাপড়ের টুকরো ফেলে দিয়েছিল রাজা, দমদমের এইচএমভি ফ্যাক্টরির ভিতরে। উদ্ধার হল সেই প্যাকেট। যে দোকান থেকে ছুরি-ভোজালি কিনেছিল রঞ্জিত, গ্লাভস আর দড়ি টোটো কিনেছিল যেখান থেকে, চিহ্নিত হল দুটোই। চার্জশিটে এতটুকু ফাঁকফোঁকর ছিল না।
জেলা আদালতের রায় বেরিয়েছিল ’৯৫ সালে। প্রায় দুই বছর ধরে চলা বিচারপর্বে একদিনের জন্যও বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত মনে হয়নি সজল আর তার পাঁচ বন্ধুকে। বিচার চলাকালীন জেল থেকে যখন আদালতে আনা হত ওদের, প্রিজ়ন ভ্যান থেকে ছয় নাবালক অভিযুক্ত নামত হাসতে হাসতে। জেলে ফিরেও যেত খোশমেজাজে, হিন্দি ফিল্মের হিট গান গাইতে গাইতে। কোনওদিন শাহরুখ খানের ‘বাজ়িগর’-এর ‘‘ইয়ে কালি কালি আঁখে’’, তো অন্যদিন সলমন খানের ‘সাজন’-এর ‘‘দেখা হ্যায় পহেলি বার…’’।
যেদিন রায় বেরিয়েছিল, উৎসুক জনতার ভিড় সামলানোর জন্য বারাসতের আদালতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল। সেদিনও হাসতে হাসতেই পুলিশের ভ্যান থেকে নেমেছিল সজলরা। চোখেমুখে কোনও ভয়ডরের চিহ্ন তো ছিলই না, বরং শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছিল একটা নেই-পরোয়া মেজাজ, ‘যা করেছি বেশ করেছি… দিক যা শাস্তি দেওয়ার।’
সজল-রঞ্জিতকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারক। বাকিদের যাবজ্জীবন কারাবাস। অলোক সাহা ওরফে টোটোর আইনজীবী প্রশ্ন তুলেছিলেন, টোটো তো ফ্ল্যাটের দরজা থেকে ফিরে গিয়েছিল। সে কেন শাস্তি পাবে? বিচারক মানেননি এ যুক্তি। বলেছিলেন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে (১২০বি, আইপিসি) যুক্ত থাকা এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনায় (৩৪ আইপিসি) শরিক হওয়ার দায় অলোক এড়াতে পারে না।
যখন বিচারক রায় পড়ে শোনাচ্ছিলেন, আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় সময় কাটিয়েছিল সজল আর তার পাঁচ বন্ধু। যখন শেষমেশ সাজা শোনানো হল, মুখে আঙুল পুরে শিস দিয়ে উঠেছিল সজল। আর হাততালি দিয়ে উঠেছিল রাজা-টোটো-বুড়ো-দেবা-রঞ্জিত। ব্যাপার দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছিল ভিড়ে ঠাসা বিচারকক্ষ। এবং সাজা ঘোষণার পর অন্যদিনের মতোই দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে জেলে ফেরার ভ্যানে উঠেছিল ওরা ছ’জন। অন্যদিনের মতোই হিন্দি গানের লাইন গুনগুন করতে করতে! অকল্পনীয়! সিনেমাতেও কেউ কখনও দেখেনি এমনটা!