—কাজটা করবি কবে?
—আমি বলব তোদের। পুজো আসছে। পাড়ার প্যান্ডেলে রাত অবধি কাজ হয়। লোক থাকে। এসময় রিস্কি হয়ে যাবে।
—তা হলে?
—পুজোটুজো মিটে যাক। শীতটা পড়ুক। সময়টা ভেবে রেখেছি অবশ্য। দাদার এখন ফার্স্ট ইয়ার। কলেজ থেকেই টিউশনিতে যায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ন’টা। বাবার অবশ্য আরও দেরি হয় ফিরতে। তোরা ঢুকবি সাড়ে আটটা নাগাদ। ওটাই পারফেক্ট টাইম।
.
২২ নভেম্বর, ১৯৯৩। সোমবারের রাত। ঘড়িতে সাড়ে আটটা। ‘পারফেক্ট টাইম’।
শুভম অ্যাপার্টমেন্টের বসার ঘরে বসে নিয়তি টিভি দেখছেন। সজল রয়েছে ভিতরে নিজের শোবার ঘরে। পাঁচতলায় ফ্ল্যাট নম্বর ৪/এ-তে বেল বাজল ঠিক আটটা পঁয়ত্রিশে। নিয়তি দরজা খোলামাত্র রাজা-বুড়ো-দেবা-রঞ্জিত ঢুকে পড়ল ঘরে। নার্ভ ফেল করল টোটোর, নারকেল দড়ি আর গ্লাভস যে জোগাড় করেছিল। ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। ঢুকল না । ফিরে গেল বন্ধুরা ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর।
নিয়তি অবাক। এদের মুখ চেনেন। পাড়ারই বা আশেপাশের এলাকার ছেলেছোকরা। পাপ্পার বন্ধু এরা। একসঙ্গে ফুটবল খেলে। এত রাতে এভাবে সবাই মিলে হঠাৎ? হাতের ব্যাগ থেকে ওগুলো কী বার করছে ওরা? দড়ি আর ছুরি না? চিৎকার করতে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে এসে নিয়তির মুখ চেপে ধরল সজল। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই যে প্ল্যানমাফিক বেরিয়ে এসেছে বাইরের ঘরে।
ভিতরের দুটো বেডরুমের একটায় নিয়ে আসা হল নিয়তিকে। গলার কাছে ছুরি ধরে রইল দেবাশিষ। একটা চেয়ারের সঙ্গে নিয়তিকে বেঁধে ফেলা হল। মুখে কাপড় গুঁজে দিল রঞ্জিত। আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া সৎমায়ের চোখে চোখ রেখে সজল বলল, ‘অনেক মজা দেখিয়েছিস না এতদিন আমাকে ? আজ তোদের মজা দেখাব। তোর ডাইনিগিরি জন্মের মতো ছুটিয়ে দেব আজ!’
কলিংবেলের আওয়াজ ফের ন’টা চল্লিশে। তার আগে ঘরের গোটাতিনেক আলমারি তছনছ করা হয়ে গেছে। সঙ্গে আনা ব্যাগে বেশ কিছু গয়নাগাটি নিয়ে বেরিয়ে গেছে বুড়ো। ফ্ল্যাটে সজলের সঙ্গে রয়ে গেছে রাজা-দেবা-রঞ্জিত। এবার দরজাটা সজল খুলল। কাঁধে কলেজের ব্যাগ নিয়ে কাজল ঘরে ঢুকতেই সজল দ্রুত বন্ধ করে দিল দরজা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাজলের গলায় ভোজালি ঠেকিয়ে দিল দেবা। চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধার কাজটা দ্রুত সারল রাজা-রঞ্জিত। সৎদাদার মুখে কাপড় গুঁজে দিতে দিতে সজল শাসাল, ‘এতদিন তো শুধু পাঁউরুটির মাখন-লাগানো দিকটাই খেয়ে এসেছিস। আজ দেখবি, সেঁকা দিকটা খেতে কেমন লাগে!’
এবার সুবলের জন্য অপেক্ষা। যিনি ফিরলেন সাড়ে এগারোটায়। এবারও দরজা খুলল সজলই। এবং ঢোকামাত্রই বসার ঘরে অপেক্ষমাণ রাজা-দেবা-রঞ্জিত মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুবলের উপর, ‘একটা শব্দ করলে পেটে ভোজালি ঢুকিয়ে দেব কিন্তু… চুপ… একদম চুপ!’
প্রাথমিক কাজ শেষ। ভিতরের দুটো ঘরে চেয়ারে বসা তিনজন। একটায় নিয়তি। অন্যটায় সুবল-কাজল। তিনজনেই হাত-পা বাঁধা এবং মুখে কাপড়-গোঁজা অবস্থায়। বাবা এবং সৎদাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সজল, ‘তোমাদের ব্যবস্থা একটু পরে করছি। আগে ডাইনিটাকে খালাস করে আসি।’
নিয়তি চেয়ারে বসে কাঁপছিলেন। সজল সজোরে গলা টিপে ধরল সৎমায়ের। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল নিয়তির। শ্বাসরোধ, মৃত্যু।
আরও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু অপেক্ষায় ছিল সুবল-কাজলের। প্রথমে বাবা। তারপর সৎদাদা। ছুরি-ভোজালি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপ চালাল সজল। সঙ্গত দিল রঞ্জিতও। গলায়-বুকে-ঘাড়ে-পেটে একাধিক আঘাত ধারালো অস্ত্রের। প্রবল রক্তপাত, মৃত্যু।
মূল ‘অপারেশন’ কমপ্লিট। পুরোটাই গ্লাভস পরে, যাতে হাতের ছাপ না পাওয়া যায় কোথাও। বন্ধুদের সঙ্গে বসার ঘরে এল সজল। এবার প্ল্যানমতো একটা ডাকাতির চেহারা দেওয়া দরকার পুরো ঘটনাকে। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে। একটু কিছু খাওয়া দরকার। ফ্রিজে সন্দেশ ছিল এক বাক্স। বার করে ধীরেসুস্থে মিষ্টিগুলো খেল চার বন্ধু। ভিতরের দুটো ঘরে তখন তিনটে মৃতদেহ। একটা ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তস্রোতে।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর সজল বলল, ‘এবার পয়সাটা রাখতে হবে। ‘‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’’-এ সেই সিনটা দেখেছিলাম না? হিরোটা দোকান ভেঙেছিল। কিন্তু কোকটার টাকা দিয়ে গিয়েছিল। এখানেও ডাকাত এসেছিল। ফ্রিজ থেকে বের করে মিষ্টি খেয়েছিল। আর মিষ্টির টাকা টেবলে রেখে গিয়েছিল… ক্লিয়ার ?’
দু’-পাঁচ টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা মিলিয়ে কুড়ি টাকার মতো জমা হল বসার ঘরের সেন্টার-টেবলে। ছুরি-ভোজালি থেকে রক্তের দাগ তেল-জল দিয়ে ধুয়ে ফেলে একেবারে সাফসুতরো করে রাখা হল সোফার উপর।
আর একটাই কাজ বাকি। সজল বলল, ‘নে, এবার বাঁধ আমাকে।’ সজলকেও চেয়ারের সঙ্গে বাঁধল রাজা-দেবা-রঞ্জিত। কিন্তু এতটাই আলতো করে, যে তিন বন্ধু বেরিয়ে যাওয়ার পরেও যাতে স্বচ্ছন্দে ভিতর থেকে দরজাটা লক করতে পারে সজল।
টিভি চলছিল। রাতটা সজল কাটাল মূলত টিভি দেখেই। ভোরের দিকে ঝিমুনি এলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ল হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। পাশের দুটো ঘরে পড়ে থাকল বাবা-সৎমা-সৎদাদার লাশ।
সজল চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল পরের দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ। ধাক্কা দিতে লাগল দরজায়। প্রতিবেশীরা সে আওয়াজ শুনলেন। পাপ্পা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চেঁচাচ্ছে ভিতর থেকে। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ফোন গেল দমদম থানায়। পুলিশ এসে দরজা ভাঙল। সুবল-নিয়তি-কাজলের লাশ উদ্ধার হল। মুক্ত করা হল চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকা সজলকেও। যে তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে সবার দিকে। এতটাই যেন আতঙ্কগ্রস্ত, কথাই বেরচ্ছে না মুখ থেকে।