সাধারণভাবে তবু কিছু ‘কমন’ কারণ উঠে আসে শিশু-কিশোরদের অপরাধমনস্কতা বিষয়ক গবেষণায়। ছোটবেলায় যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া বাচ্চাদের মধ্যে ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা গিয়েছে বহুক্ষেত্রে। তেমনই বাবা-মায়ের অসুখী দাম্পত্য এবং তজ্জনিত অশান্তির সাক্ষী থাকা ছেলেমেয়েদেরও দেখা গিয়েছে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে। সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা যায় আরও বহুবিধ। মা-বাবার বিচ্ছেদের সাক্ষী থাকা, অভিভাবকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত স্নেহ-ভালবাসা না পাওয়া, সহোদর ভাইবোনের সঙ্গে সুসম্পর্কের অভাব ইত্যাদি প্রভৃতি।
কারণ চিহ্নিত করা গেলেও ক্ষেত্রবিশেষে নির্মূল করা যায় না শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা, এমন ধারণাও পোষণ করেন অনেকে। এঁদের মতে, কেউ কেউ জন্মায়ই অপরাধপ্রবণতা নিয়ে। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার জন্য কোনও কারণ বা অনুঘটকের প্রয়োজন হয় না জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ শিশু-কিশোরদের।
সত্যিই কি ‘বর্ন ক্রিমিনাল’ বলে কিছু হয়? অপরাধবিজ্ঞানের জনক হিসেবে যিনি স্বীকৃত, যিনি বিজ্ঞান আর নৃতত্ত্বকে একসূত্রে বেঁধে অপরাধ-গবেষণার নয়া দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন, সেই ইতালীয় মনস্তত্ত্ববিদ সিজার ল্যামব্রোজো লিখেছিলেন, ‘many individuals are born with perverse propensities, regardless of their parents, attempts to turn them around.’
সজলের বেড়ে ওঠার দিনগুলো যেভাবে কেটেছিল, সেই নিরিখে বিচার করলে ‘বর্ন ক্রিমিনাল’-এর গোত্রে কোনওভাবেই ফেলা যায় না তাকে। একটু তলিয়ে ভাবলে বরং মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কথা। লোভ সামলানো যায় না গল্পটির কয়েকটি অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার।
‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।
সেও সর্বদা মনে-মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ, এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিম্বা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।
অতএব, এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত স্থান বালকের কাছে নরক।’
গল্পের ফটিকের সঙ্গে বাস্তবের সজলের অমিল বিস্তর। ফটিক মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল না। শান্তশিষ্ট ছোটভাই মাখনের উপর তার ‘দাদাগিরি’-তে মা মাঝেমাঝে রুষ্ট হতেন, এই পর্যন্তই। ফটিক স্বেচ্ছায় কলকাতায় মামার বাড়িতে এসেছিল। মামীর ঔদাসীন্য অসহনীয় বোধ হওয়ায় সে মামার বাড়ি থেকে মরিয়া যাত্রা শুরু করেছিল ‘মাতৃভবনের’ উদ্দেশে। মধ্যপথে ঘোর অসুস্থ হয়ে পড়ে ফিরতে হয়েছিল মামার বাড়িতেই। খবর পেয়ে যতক্ষণে ছুটে এসেছিলেন মা, ততক্ষণে ফটিকের ‘ছুটি’-র সময় হয়ে এসেছিল।
কোথায় ফটিক আর কোথায় সজল! আট বছর বয়স থেকে বাধ্যতই মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল সজল। ‘মাতৃভবন’ থেকে চলে আসার পর আর ফেরা হয়নি। বাবা আর সৎমায়ের নিস্পৃহতা-নিষ্ঠুরতা এবং লাগাতার অযত্ন-অনাদর-অবহেলা কিশোর সজলকে দিক্ভ্রান্ত করে তুলেছিল।
প্রেক্ষিত-পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা ঠিকই। তবু বয়ঃসন্ধির কিশোরের যে অস্তিত্ব-সংকট, পরিপার্শ্বের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার যে তাগিদ, সেই মোহনাতেই যেন অনেকটা মিশে যায় কল্পনার ফটিক আর রক্তমাংসের সজল।
‘ছুটি’ সজলেরও হয়ে গিয়েছিল, সুস্থ জীবন থেকে। তার অভিমান জমতে জমতে পরিণত হয়েছিল ক্ষোভে। ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে হতে রাগে। রাগ সঞ্চিত হতে হতে প্রতিশোধস্পৃহায়। বন্ধুদের সঙ্গে ছক কষতে বসেছিল বাড়ির ‘হিসেবটা মিটিয়ে দেওয়ার’।
—প্ল্যানটা তো বল?
—বলছি। আগে তোরা বল? তোরা সঙ্গে আছিস তো…
সমস্বরে উত্তর এসেছিল বন্ধুদের থেকে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! বল না কী কী করতে হবে!’
সজল খুলে বলেছিল তার পরিকল্পনা। সব শুনে রঞ্জিত বলেছিল… ‘দে শালা শেষ করে, কুত্তার জীবন কাটাচ্ছিস, এবার এসপার-ওসপার। আর তোর বাবা, সৎমা আর সৎদাদাটা ফুটে গেলে ফ্ল্যাটটা তোর। সব সম্পত্তিও তোর। মিটিয়ে দে শালা হিসেব।’
—হুঁ… কিন্তু তাড়াহুড়ো করলে চলবে না, সজল বলেছিল, কী কী লাগবে, তার একটা লিস্ট করা দরকার। গ্লাভস, নারকেল দড়ি, ছুরি, ভোজালি…