বাড়ি, না জেলখানা এটা? বাবা লোকটা একটা কসাই। এমন বাবা থাকার থেকে না-থাকা ঢের ভাল । আর এমন সৎমা যেন চরম শত্রুরও না হয়। ডাইনি ডাইনি! রইল বাকি সৎদাদা। পাকা শয়তান একটা। সুযোগ পেলেই বাবা আর ওই ডাইনিটার কাছে চুকলি করে মার খাওয়ায় তাকে। বন্ধুরা ঠিকই বলে, বাবাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে সব সম্পত্তি দাদার নামে লিখিয়ে নেওয়ার তাল করছে ডাইনিটা। বাবার যা কিছু, সব দাদা ভোগ করবে। আর তার জীবন কাটবে এদের দয়ায়, চাকরগিরি করে। নাহ, ঢের হয়েছে! আর নয়। তিনটেকেই মেরে সে জেলখানায় থাকবে, তা-ও ভাল। কিন্তু এভাবে আর নয়।
পাড়ার ফুটবল টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালটাও তাকে খেলতে দিল না ওরা। অথচ এই ম্যাচটা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কত প্ল্যানিং করেছিল গত পরশু। ওরা তিনজন সিনেমা দেখতে গেল। সে খেলতে যেতে চেয়েছিল বলে বাবা বলল, ‘পেলে হবি? মারাদোনা হবি?’ দাদার জামাকাপড় গুছিয়ে রাখার কাজ চাপিয়ে গেল ডাইনিটা, ‘ঠিকঠাক না হলে ফিরে এসে মজা দেখাব।’ আর দাদা খ্যাকখ্যাক হাসল, ‘শুনলি তো পাপ্পা!’ পাছে সে বেরতে না পারে, বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে বেরল বাবা।
ওরা ফেরার পর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে যখন মাঠে এসেছিল সজল, তখন টিম শেষ মিনিটের গোলে হেরে যাওয়ার শোকে মুহ্যমান। সঙ্গে আক্ষেপ, ‘পাপ্পা থাকলে ম্যাচটা এভাবে হারতে হত না।’ পাপ্পার মুখে সব শুনে টোটো সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, ‘মন খারাপ করিস না…পরের মাসে বিরাটিতে একটা টুর্নামেন্ট আছে শুনছি… তখন তরুণ সংঘ-র সঙ্গে হিসেবটা মিটিয়ে দেব।’
পাপ্পার প্রতিক্রিয়ায় একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল বন্ধুরা, ‘তার আগে বাড়ির হিসেবটা মিটিয়ে দেওয়া দরকার।’
—মানে? হিসেব মিটিয়ে দেওয়া মানে?
—আগে বল, গতকাল তোরা কে কে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ দেখেছিস?
পাপ্পার প্রশ্নের উত্তরে রাজা-টোটো-বুড়োরা মাথা নেড়েছিল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ… দেখেছি তো। কেন?’
—ওই সিনটা দেখলি? কোকের ক্যানটা নিয়ে পয়সা দেওয়ার সিনটা?
‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’। আটের দশকের শেষদিকে টিভিতে শুরু হওয়া যে নিউজ় সিরিজ় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময়। সে রাজনীতিই হোক বা খেলাধুলোর জগৎ বা বিনোদনের দুনিয়া, বিশ্বে গত সাতদিনে গুরুত্বপূর্ণ যা যা কিছু ঘটেছে, তার হরেক ঝলক প্রতি শুক্রবার রাত আটটায় উঠে আসত দূরদর্শনে। প্রণয় রায়ের স্মার্ট ঝকঝকে পরিবেশনা আলাদা মাত্রা দিয়েছিল প্রোগ্রামে। ভারতীয় টিভি-তে এই ধরনের নিউজ় সিরিজ় সেই প্রথম। বড়রাও দেখতেন, তবে বিশেষত সেসময়ের স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের কাছে নেশার মতো হয়ে উঠেছিল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’। শুক্রবার রাত আটটা মানেই তখন টিভি এবং প্রণয় রায়।
পাপ্পা গতকালের এপিসোডটার কথা বলছিল। সে বছরই, ’৯৩ সালে, রিলিজ় করেছিল মাইকেল ডগলাস অভিনীত হলিউড থ্রিলার ‘ফলিং ডাউন’। সুপারহিট এই ছবির একটা বিখ্যাত দৃশ্য গতকাল দেখানো হয়েছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’-এ। একটা মাঝারি সাইজ়ের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিকের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে বচসায় জড়িয়ে পড়েন মাইকেল। স্টোরের মালিক একটা বেসবল ব্যাট নিয়ে মারতে যান মাইকেলকে। ব্যাটটা কেড়ে নেন মাইকেল। দোকানের অর্ধেক জিনিসপত্র ওই ব্যাট দিয়েই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। তারপর একটা কোকের ক্যান তুলে নেন দোকানে রাখা একটা শেলফ থেকে। কোকের দাম হিসেবে দোকানের ক্যাশবক্সে পঞ্চাশ সেন্ট রেখে দেন। এবং কিছুই যেন ঘটেনি, এমন একটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যান দোকান থেকে। কোকের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে।
রাজা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ… ওটা হেব্বি ছিল। দোকানটার বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার পর কী স্মার্টলি কোকের ক্যানটা নিল। আর দামটা দিয়ে কী ক্যাজুয়ালি বেরিয়ে গেল! কিন্তু তুই ওই সিনটার কথা হঠাৎ বলছিস কেন?’
পাপ্পা হেঁয়ালি-মেশানো উত্তর দেয়, ‘ওটাও প্ল্যানের মধ্যে থাকবে।’
টোটো বলে ওঠে, ‘আরে প্ল্যানটা তো বল! কী প্ল্যান, কিসের প্ল্যান?’
.
অপরাধবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল শিশু বা কিশোরমনের অপরাধপ্রবণতা। যা নিয়ে সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত কত যে গবেষণা হয়েছে, হয়ে চলেছে নিরন্তর, তার ইয়ত্তা নেই কোনও। শিশু-কিশোরদের ‘অপরাধী’ হয়ে ওঠার নেপথ্য কারণগুলি নিয়ে যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যা আছে এত, যে নির্যাসটুকু লিখতে গেলেই আস্ত একটা বই হয়ে যায়।
একটা বিষয়ে অবশ্য অপরাধ-গবেষকরা সকলেই কম-বেশি সহমত, শিশু বা কিশোরদের ঘটানো প্রতিটি অপরাধ তাদের পটভূমির বিচারে এতটাই আলাদা, চরিত্রবৈশিষ্ট্যে এতটাই ভিন্ন, যে নির্দিষ্ট কোনও কারণ বা কারণসমূহকে চিহ্নিত করা কঠিন।
কিংবদন্তিসম ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ ক্যাথরিন ব্যানহাম তাঁর বহুপঠিত প্রবন্ধ ‘Factors Contributing to Juvenile Delinquency’-তে স্পষ্ট লিখেছেন, ‘Each juvenile offense is the outcome of complexity of causes, some of whose origins date back years before the committal of the offense and other whose origins are more obviously and immediately connected with the act of delinquency. It has been shown that a different set of causes is involved in each individual case. It is impossible therefore to state the group of causes which will invariably result in any particular offence.’