রাত্রে শুয়ে শুয়ে চোখে জল এসেছিল সেদিন। তার কি আর কোনওদিনই মায়ের সঙ্গে দেখা হবে না? সে না হয় ভিক্ষে করেই খেত। সে কি বাবাকে বলেছিল মায়ের কাছ থেকে এখানে নিয়ে আসতে? তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এই নতুন মা কত আদর করে দাদাকে। চুল আঁচড়ে দেয়। স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। কই, কখনও তো তাকিয়েও দেখে না তার দিকে! নিজের ছেলে নয় বলেই তো? তা হলে সে-ই বা কেন ‘মা’ বলে ডাকবে সৎমাকে?
বাবার উপরও ভারী অভিমান হয় তার। বাবা কি অন্ধ? দেখতে পেল না, গত পরশু রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় দাদার প্লেটে দুটো দরবেশ পড়ল, আর তার প্লেটে একটা। বাবারই তো আনা মিষ্টি। প্যাকেটে আরও তিন-চারটে মিষ্টি তো ছিলই। সেগুলো নতুন মা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে দিল। কেন ঢুকিয়ে রাখল, সে জানে। ওগুলো কাল দাদার টিফিনে যাবে। সে লজ্জায় বলতেও পারল না, ‘আমাকেও আরেকটা দাও।’ অথচ দরবেশ খেতে সে কী অসম্ভব ভালবাসে!
চাইলেই হত, কিন্তু তবু কেন সে চাইতে পারল না ? শুধু লজ্জায়? না কি ভয়েও? নতুন মা-কে সে ভয়ই পায়। এখানে আসার পর থেকে একদিনও তার সঙ্গে ভাল করে কথা বলেনি নতুন মা। বাবার কি এসব চোখে পড়ে না? নতুন মায়ের কথার উপরে বাবাই বা কথা বলে না কেন? বাবাও ভয় পায় এত? তা হলে সে আর কাকে নিজের কথা বলবে?
শৈশব থেকে কৈশোরের দিকে যত এগোচ্ছিল কাজল-সজল, ছেলে আর সৎছেলের মধ্যে তফাতটা বেআব্রু করে দিচ্ছিলেন নিয়তি। এবং সব দেখেশুনে, জেনেবুঝেও উদাসীন থাকছিলেন সুবল। মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত সজলের একটা ভরসাস্থল দরকার ছিল। সুবল সেই ভরসার পরিসরটুকু ছোটছেলেকে দিতে পারেননি। সৎবাবার মতো আচরণ করতেন ছোটছেলের সঙ্গে।
কীরকম?
কাজল ক্রিকেট খেলতে ভালবাসে। ক্রিকেট-কিট চাই, আবদার করল বাবার কাছে। নতুন মা-ও ইনিয়েবিনিয়ে বলল বাবাকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বড়ছেলের জন্য ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস-অ্যাবডোমেন গার্ড হাজির। সজল ফুটবল-পাগল। কবে থেকে বাবাকে বলছে একজোড়া স্পাইক বুট আর শিনগার্ডের জন্য। ক্রিকেট-কিটের তুলনায় অনেক কম খরচায় হয়ে যায়। অথচ সময়ই হচ্ছে না বাবার। মনে করাতে গেলে খিঁচিয়ে উঠছে বরং। অন্যায় নয়?
সজল আঁকতে ভালবাসে। ভাল আঁকে। রং-তুলিকে তার বন্ধু বলে মনে হয়। স্কুলে ড্রয়িং কন্টেস্টে সবসময় ফার্স্ট হয়। তাদের ড্রয়িং স্যার বলেছেন, ‘তোমার ট্যালেন্ট আছে আঁকায়। একটু মাজাঘষা করলে ভাল পেইন্টার হওয়ার সম্ভাবনা আছে তোমার। বোলো বাড়িতে।’ সে বলেছিল বাড়িতে, কিন্তু বাবা শুনলে তো! অথচ নতুন মা একবার বলতেই বাবা তড়িঘড়ি সুইমিংয়ে ভরতি করিয়ে দিল দাদাকে। তার সাঁতার অত ভাল লাগে না। তার ছবি আঁকতে ভাল লাগে। বাবা জানেও সেটা। পারত না তাকে একটা ড্ৰয়িং শেখার স্কুলে ভরতি করিয়ে দিতে? বলল একবারও? অবিচার নয়?
হ্যাঁ, সে পড়াশুনোয় ভাল নয় বড় একটা। টেনেটুনেই পাশ করে পরীক্ষায়। কিন্তু দাদাই বা লেখাপড়ায় কীসের দিগ্গজ? সে এইট থেকে নাইনে ওঠার পরীক্ষায় মোটেই ভাল করেনি। অঙ্ক আর ইংরেজিতে ফেল করতে করতে বেঁচে গেছে। রিপোর্ট কার্ড দেখে কী মারটাই না মারল বাবা! কিন্তু দাদার মার্কশিট দেখে শুধু বলল, ‘পড়াশুনোয় আরও মন দিতে হবে।’ অথচ ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষায় একটা সাবজেক্টেও দাদা একশোয় পঞ্চাশের বেশি পায়নি। তার বেলা? যত মার বরাদ্দ শুধু তার বেলায়? অত্যাচার নয়?
বাবা-মায়ের আচরণে কাজলও দ্রুত বুঝতে শুরু করেছিল, এবাড়িতে তারই জন্য বরাদ্দ রাজার পার্ট। সৎভাই সজল হীনদরিদ্র প্রজামাত্র। ক্লাস এইট থেকে টেনের মধ্যবর্তী সময়টায় বাড়িতে ক্রমশ একা হয়ে পড়েছিল সজল। তার রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমান উগরে দেওয়ার একমাত্র জায়গা হয়ে উঠেছিল ফুটবল মাঠের বন্ধুরা। মাঠে বিকেলের ফুটবল আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাটুকুই ছিল সজলের জীবনে একমাত্র সবুজ। বন্ধুরা শুনত পাপ্পার বাড়ির রোজনামচা। শুনত, ক্রমশ বাড়ির ‘ছেলে’ থেকে কীভাবে বাড়ির ‘চাকরে’ পরিণত হচ্ছে পাপ্পা।
চাকর ছাড়া কী? ক্লাস এইটে ওঠার পরই সজলকে বাসন মাজার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন নিয়তি। ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাসন-মাজার লোক। ‘প্লেটগুলো একটু ধুয়ে দিস তো পাপ্পা’ দিয়ে শুরু। ক্রমে পাকাপাকিভাবে দিনরাতের বাসন মাজার কাজ ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। শুধু কি তাই? কাজলের জামাকাপড় ইস্ত্রি করা। রাতে শোবার আগে নিজের বুট পালিশ করার সময় কাজলের বুটও পরিষ্কার করে রাখা। ‘কেন, দাদা করতে পারে না নিজেরটা?’ একদিন বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেছিল সজল। উত্তরে রে রে করে তেড়ে এসেছিল নতুন মা। ডেকে এনেছিল বাবাকে, ‘শুনে যাও, মেজাজটা শুধু দেখে যাও তোমার ছেলের। দাদার জুতোটা একটু পালিশ করে দিতে বলেছি বলে প্রেস্টিজে লেগেছে বাবুর! তোর মা তোর জুতো পালিশ করার জন্য কতজন দাসদাসী রেখেছিল রে?’
সুবল এসব ক্ষেত্রে যা করে থাকতেন, সেটাই করেছিলেন। উদ্দাম মেরেছিলেন সজলকে, ‘মুখে মুখে কথা বলার সাহস হল কোত্থেকে তোর? যা বলা হচ্ছে করবি। নয়তো দূর করে দেব বাড়ি থেকে। পচে মরবি তোর ওই ভিখিরি মায়ের কাছে।’ সজল লক্ষ করেছিল, সে যখন মার খাচ্ছিল, দাদা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিল তখন। ভাইয়ের হেনস্থায় আনন্দ যেন আর ধরছে না। একবারও বলতে পর্যন্ত এল না, ‘পাপ্পাকে আর মেরো না।’