’৮২-৮৩ সাল তখন। সজলের তখন কতই বা বয়স? পাঁচ-ছয় সবে। সে মায়ের সঙ্গে থাকে। সে এটা বোঝে যে তার বাবা-মা একসঙ্গে থাকে না। বাবা সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন আসেই তার আর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু যখন আসে, তাকে বা মা-কে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার কথা কখনও বলে না। কেন এমনটা হয়েছে, কেন এমনটা হয়, সেটা বোঝার মতো বয়স তখনও হয়নি বালক সজলের। তার শুধু মনে হয়, বাবা-মা দু’জনের সঙ্গেই থাকতে পারলে ভারী মজা হত।
সুবল দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন মিনতির শরীরী মোহে সাময়িক আচ্ছন্ন হয়ে। মোহের একটা আয়ু থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে আয়ুর ক্ষয় ঘটছিল স্বাভাবিক নিয়মেই। মিনতির কাছে আসা ক্রমশ কমিয়ে দিচ্ছিলেন সুবল। আগে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন আসতেন। সেটা কমে দাঁড়াল হপ্তায় একদিনে। মাসিক খরচ হিসেবে যা দিতেন এতদিন, তার এক-চতুর্থাংশও দিচ্ছিলেন না আর। আর সে দেওয়াও ছিল অত্যন্ত অনিয়মিত।
বাবার ব্যবহার অদ্ভুত লাগতে শুরু করেছিল ছ’বছরের সজলেরও। ইদানীং বাবা কমই আসে। কিন্তু যখন আসে, মুখ হাঁড়ি করে থাকে সবসময়। এই তো সেদিন, সে শুধু ঘুড়ি-লাটাই কেনার জন্য পয়সা চেয়েছিল, তাতেই বাবা কী ভীষণ রেগে গিয়েছিল। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘এক পয়সাও দেব না। আর যদি ঘ্যানঘ্যান করিস, গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে দেব।’ ভয়ে আর কথা বাড়ায়নি সে। সুবলের ভাবভঙ্গি দেখে কথা বাড়াতেন না মিনতিও। যিনি তখনও জানতেন না, সুবলের সঙ্গে নিয়তির যোগাযোগ ফের স্থাপিত হয়েছে। জানতেন না, কিছুদিনের মধ্যেই কিশোর কাজলকে নিয়ে দমদমে স্বামীগৃহে ফিরতে চলেছেন সুবলের প্রথম স্ত্রী নিয়তি।
মিনতি ছিলেন নেহাতই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই আর। দুই দাদা আছেন, যাঁরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সুবল অর্থসাহায্য কমিয়ে দেওয়ায় মিনতি অকূল পাথারে পড়লেন। সেলাইয়ের কাজ শুরু করলেন। আর এ বাড়ি-ও বাড়ি খুচরো রান্নার কাজ। নিজের এবং ছেলের পেট চালাতে পরিশ্রম করতেন উদয়াস্ত। অর্থকষ্ট ছিল তীব্র, সামর্থ্য ছিল না সজলকে কোনও ভাল স্কুলে ভরতি করানোর। স্থানীয় যে বিনে-মাইনের কর্পোরেশন স্কুলে ভরতি করিয়েছিলেন সজলকে, সেটা নামেই স্কুল। সেখানে পড়াশুনোর নামগন্ধ নেই বিশেষ। সেখানে বইখাতার থেকে ডাঙ্গুলি-পিট্টু-গুলতির চল বেশি।
সজলের যখন আট বছর, সুবল এলেন একদিন। কোনও ভূমিকা ছাড়াই মিনতিকে বললেন, ‘এই পরিবেশে থাকলে, এই থার্ড ক্লাস স্কুলে পড়লে পাপ্পার কিছুই হবে না। লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ঠিক করেছি, পাপ্পাকে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব। ভাল স্কুলে ভরতি করাব।’
ধোপে টিকল না মিনতির মৃদু প্রতিবাদ। একপ্রকার বাধ্যই হলেন ছেলেকে ছেড়ে দিতে। নিজেও বুঝতে পারছিলেন, ছেলেকে একটা ভদ্রস্থ স্কুলে পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। হবেও না অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে। ছেলের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। ছাড়া গোরুর মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। যার-তার সঙ্গে মেশে। শাসন করার কেউ নেই। বাবার কাছে গেলে অন্তত একটা নিয়মের মধ্যে থাকবে। সুবল যখন বললেন, ‘এখানে এভাবে থাকলে ছেলেটা ক্রিমিনাল তৈরি হবে’, মুখে উত্তর জোগায়নি মিনতির। অবশ্য বাক্যটা যখন চরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারণ করছিলেন সুবল, নিজেও কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন, শব্দগুলো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে কয়েক বছরের মধ্যেই, ছেলের ‘ক্রিমিনাল’ হওয়ার বীজ বরং বপন হবে বাবার কাছেই, এবং তাতে শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটবে দ্রুত?
সুবল ছোটছেলেকে নিয়ে এলেন দমদমের ফ্ল্যাটে। প্রথম স্ত্রী নিয়তির তীব্র এবং সহজবোধ্য অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করেই। প্রথম দু’-তিন বছর মন্দ কাটেনি সজলের। সাজানো-গোছানো নতুন বাড়ি। নতুন স্কুল, নতুন বইখাতা। সবচেয়ে ভাল যেটা, এই নতুন বাড়িটার কাছেই একটা বড় মাঠ আছে । সেখানে সজল যায় বিকেলে ফুটবল খেলতে। খেলতে খেলতেই জুটে গেছে নতুন বন্ধু।
বাড়িতেও দিব্যি সময় কেটে যেত দাদার সঙ্গে খুনসুটি করে। কাজল, তার নতুন দাদা। তার থেকে তিন বছরের বড়। বাবা বলে দিয়েছে, দুই ভাই যেন মিলেমিশে থাকে। ঝগড়াঝাঁটি যেন না করে। ঝগড়া যে হয় না, তা নয়। তবে মিটেও যায়।
বাড়িতে একজনকে অবশ্য তার শুরু থেকেই পছন্দ হয়নি। ‘নতুন মা’। এই ফ্ল্যাটটায় আসার পর যাকে দেখিয়ে বাবা বলেছিল, ‘পাপ্পা, ইনি হলেন তোমার নতুন মা, এঁকে ‘‘মা’’ বলে ডাকবে আজ থেকে।’ পাপ্পা তো অবাক! মা তো মা-ই! তার আবার নতুন-পুরনো হয় নাকি? তা ছাড়া তার তো মা আছে। ইনি তো দাদার মা। নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে মা বলে ডাকা যায় নাকি? তবু পাছে বাবা বকে, এই নতুন মা-কেই ‘মা’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল।
মায়ের জন্য শুরুর দিকটায় মন খারাপ করত খুব। কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেই বাবার মুখ থমথমে হয়ে যেত। বলত মায়ের কথা ভুলে যেতে। একদিন মায়ের কথা মনে পড়ছিল খুব। ‘মায়ের কাছে নিয়ে চলো’ বলে সকাল থেকে একটু বেশিই আবদার জুড়েছিল। বাবা একটা সময় ঠাস করে চড় কষিয়ে দিয়েছিল। ‘তোকে আমি শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি আর কোনওদিন যদি মায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা শুনেছি ঘরে বন্ধ করে রেখে দেব। নেমকহারাম তৈরি হয়েছে একটা। ভিক্ষা করে খেতিস ওই মায়ের কাছে থাকলে।’