—তোরা কে কে গতকালের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ দেখেছিস?
.
—না না স্যার, নাকটা এরকম না। আপনি নাকটাকে একটু বোঁচা করে ফেলছেন। ওর নাকটা খাড়া, ধারালো। হ্যাঁ, চুলটা ঠিক আছে। একদম এমনটাই ঝাঁকড়া। জুলপি অবধি শুধু নামিয়ে দিন। ঠোঁটটা মনে হয় আর একটু পাতলা হবে… হ্যাঁ হ্যাঁ… এরকমই। চোখদুটো কিন্তু হচ্ছে না স্যার। বললাম না… বিকাশের চোখগুলো এমন ছোট নয়। বরং বড় বড়। ঝকমক করে একদম। হ্যাঁ স্যার… এইবার ঠিক হচ্ছে… মুখের আদলটা আসছে। গোঁফটা পারফেক্ট হয়েছে…।’
লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ‘পোর্ট্রেট পার্লে’-র প্রক্রিয়া চলছে। অপরাধীর চেহারার বিবরণ শুনে পেশাদার শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকানো হচ্ছে। যোধপুর পার্কের এক গেস্ট হাউসে দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে। দু’জন ধরা পড়েছে। স্বীকারও করেছে অপরাধ। জেরায় গোয়েন্দারা জেনেছেন, এই দু’জন চুনোপুঁটি লেভেলের ক্রিমিনাল। ডাকাতিটায় লিড করেছিল বিকাশ বলে একজন। মাস্টারমাইন্ড ওই বিকাশই। যে এখনও ধরা পড়েনি। ধৃত দু’জনের থেকে বিকাশের চেহারার বর্ণনা শুনে স্কেচ করা হচ্ছে।
অধরা অপরাধীর ছবি আঁকা শেষ। ডাকাতি-দমন বিভাগের ওসি এলেন। যিনি নিজের তিরিশ বছরের কেরিয়ারে অজস্র অপরাধীর ঠিকুজি-কুষ্ঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন, বহু দাগি আসামির ইতিহাস-ভূগোল যাঁর ঠোঁটস্থ। ওসি স্কেচটা হাতে নিলেন। অন্তত মিনিটদশেক দেখলেন একদৃষ্টিতে। যখন শেষ হল দেখা, ততক্ষণে ভুরু কুঁচকে গেছে ভদ্রলোকের। দ্রুত ফোন করলেন গোয়েন্দাবিভাগের সিআরএস (ক্রাইম রেকর্ডস সেকশন)-এ। যেখানে সযত্নে নথিবদ্ধ থাকে শহরের এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কবে কোন অপরাধী ধরা পড়েছিল, তার সবিস্তার খতিয়ান। থাকে গ্রেফতারির সময়ের ছবি। সিআরএস থেকে একটা ছবি চেয়ে পাঠালেন তড়িঘড়ি। আঠারো বছর আগের এক মামলায় মূল অভিযুক্তের ছবি।
এসে গেছে ছবি। যা ধৃত দুই অভিযুক্তের সামনে মেলে ধরেছেন ওসি, ‘ভাল করে দ্যাখ তো… একে চিনতে পারিস কিনা।’ ছবিটায় একটু চোখ বুলিয়েই মুখ খুলল ধৃতদের একজন, ‘স্যার! এটা তো মনে হচ্ছে বিকাশেরই ছবি… ছোটবেলার ছবি।’ অন্যজনও সায় দিল, ‘হ্যাঁ স্যার, বাচ্চা বয়সের ছবি, কিন্তু এটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিকাশই!’
ওসি মৃদু হাসেন। তাকান পাশে দাঁড়ানো মধ্যতিরিশের সহকর্মী সাব-ইনস্পেকটরের দিকে, ‘স্কেচটা দেখে যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। এর নাম আদৌ বিকাশ নয়। নামটা বানিয়ে বলেছিল এদের।’
—বিকাশ নয়? তা হলে কে স্যার?
—তোমার সেই আর্লি নাইন্টিজ়ের কেসটা মনে আছে? নাইন্টিন নাইন্টি থ্রি টু বি প্রিসাইস। কলকাতার নয়, নর্থ টুয়েন্টি ফোর পরগনার মামলা। তখন বোধহয় তোমরা স্কুলে-টুলে পড়ো। আরে, দমদমের সেই কেসটা, যেটা নিয়ে তখন তুমুল হইচই হয়েছিল। ওই যে, একটা ষোলো বছরের ছেলে তার পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে নিজের বাবা, সৎমা আর সৎদাদাকে খুন করেছিল ঠান্ডা মাথায়… মনে পড়ছে?
—কী বলছেন স্যার! ওটা মনে থাকবে না? তখন ক্লাস এইটে পড়ি। কাগজে রোজ গোগ্রাসে পড়তাম মামলাটার কথা। ছেলেটা তো প্রায় আমাদেরই বয়সি ছিল। ছবি বেরত কাগজে। সজল বারুই!
—ইয়েস… সজল বারুই। সে সময় যে ছবিগুলো বেরিয়েছিল কাগজে, সেই চেহারাটাই মনে আছে লোকের। সে সময়ের ছবিটা আর এই স্কেচটা পাশাপাশি রাখো… এত বছরেও চেহারা বিশেষ একটা পালটায়নি। একটু মাংস লেগেছে শরীরে। বাকি ফিচার্স মোটামুটি একই আছে। বিকাশটা ভুয়ো নাম। এটা মোস্ট ডেফিনিটলি সজল। সজল বারুই।
সজল বারুই মামলায় ভূমিকা অনাবশ্যক, প্রাক্-কথন অপ্রয়োজনীয়। সরাসরি ঢুকে পড়ি ঘটনায়।
সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল সুবল-নিয়তির। সেটা সাতের দশকের মাঝামাঝি। সুবলের কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল সদাগরি আপিসের মোটামুটি ভদ্রস্থ চাকরি দিয়ে। পাশাপাশি পৈতৃক ব্যবসাও ছিল একটা। দুয়ে মিলে রোজগার মন্দ হত না। সচ্ছল পরিবার বললে পুরোটা বলা হয় না। ‘সম্পন্ন’-ই সঠিক বিশেষণ।
নিয়তির সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না শ্বশুর-শাশুড়ির। খিটিমিটি লেগেই থাকত। বিয়ের মাসছয়েকের মধ্যেই সুবল পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দমদমে উঠে এসেছিলেন তিন কামরার ফ্ল্যাটে। ৫, এন সি সেনগুপ্ত সরণিতে ‘শুভম অ্যাপার্টমেন্ট’-এর পাঁচতলায়। ফ্ল্যাট নম্বর ৪/এ। বিয়ের বছরখানেক পর পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন নিয়তি। নাম রাখা হয়েছিল কাজল।
সুবল চরিত্রবান পুরুষ ছিলেন, এমন ‘বদনাম’ দেওয়া যাবে না। পরনারীসংসর্গে অবিচল আগ্রহ ছিল। মিনতি নামের এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। এবং এতটাই গভীরভাবে, যে নিয়তিকে একপ্রকার পরিত্যাগই করলেন। দেড় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হলেন নিয়তি।
সুবল নতুন সম্পৰ্ককে বৈধতাও দিলেন। কালীঘাটে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করলেন মিনতিকে। তবে দমদমের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন না দ্বিতীয় স্ত্রী-কে। উত্তর শহরতলির প্রত্যন্তে একটা দেড় কামরার ঘুপচি ফ্ল্যাট ভাড়া করলেন। মিনতির থাকার ব্যবস্থা হল সেখানে। সারাদিনের কাজ সেরে সুবল সন্ধেয় আসতেন। রাত কাটিয়ে দমদমে ফিরে যেতেন সকালে। মিনতির সঙ্গে বিয়ের বছরদেড়েকের মাথায় জন্ম হল সজলের। সুবলের দ্বিতীয় সন্তান। যার ডাকনাম রাখা হল পাপ্পা। সুবলের দুই ছেলে বেড়ে উঠতে লাগল যে যার মায়ের প্রতিপালনে। নিয়তির কাছে কাজল। মিনতির কাছে সজল।