তিন নম্বর কারণ, এলাকায় নিজের একটা ‘রবিনহুড’ ইমেজ গড়ে তোলা। পাড়ার কোনও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ের বিয়েতে হয়তো টাকা জোগাড় হচ্ছে না লোক খাওয়ানোর। মেয়ের বাবা শ্যামলকে এসে ধরলেন। এলাকার কোনও ক্যাটারারকে ডেকে শ্যামল নিজস্ব ভঙ্গিতে হুকুম জারি করল, ‘ভাল মেনু করবি। মাছ-মাংস রাখিস। আর যা বিল হবে, তার থার্টি পারসেন্টের বেশি নিবি না। কিন্তু তা বলে খাবারের কোয়ালিটি যদি খারাপ হয়েছে শুনি…।’ কথা শেষ করার প্রয়োজনই হত না, বিয়ের ভোজ মিটে যেত নামমাত্র টাকায়। পাড়ার কোনও মেধাবী ছাত্রের কলকাতার ভাল কলেজে অ্যাডমিশনের টাকা জোগাড় হচ্ছে না। শ্যামলের দরবারে গিয়ে আর্জি জানালে মুশকিল আসান। স্থানীয় কোনও ব্যবসায়ীকে ফোন করে সামান্য চমকালেই কাজ হয়ে যেত। টাকা পৌঁছে যেত ছাত্রের পরিবারে। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে কেউ ঝগড়া করে না। কোন্নগরে বাস করে কেউ শ্যামলের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়াত না।
একটা পরিত্রাতা ইমেজ তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা বলে এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই যে শ্যামল আদতে দয়ালু প্রকৃতির এবং গরিবের দুঃখে বুক ফেটে যেত। নিজের রোজগার ছিল অঢেল। কিন্তু যা যা ‘পরোপকার’ করে পাড়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার জন্য একটা পয়সাও নিজের পকেট থেকে খরচ করত না। খোলাখুলিই বলত, ‘লোকে জানছে, শ্যামলদার জন্য কাজটা হল। আমার ওটুকুই দরকার। আমার মাল খসছে কী অন্যের, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।’
স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার ছিল। স্থানীয় মানুষের কিছু উপকার করে কৃতজ্ঞতা কিনতে থাকো এলাকায়, যাতে ‘শ্যামলদা’-র বিপদে-আপদে লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘বিপদ-আপদ’ মানে পুলিশের ‘রেইড’, ‘ঝাঁপিয়ে পড়া’ মানে চোখকান খোলা রেখে পুলিশের গতিবিধির ব্যাপারে ‘দাদা’-কে খবর দেওয়া। খবরের বিনিময়ে অনেককে মাসোহারা দিত শ্যামল, আগেই লিখেছি। কিন্তু এমনও অনেকে ছিল, যারা বিনে পয়সাতেই ‘ইনফর্মার’-এর কাজ করত। পরোপকারে বিনিয়োগের ফসল সুদে-আসলে এভাবেই তুলেছিল শ্যামল।
কারণ নম্বর চার, নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস না করার প্রবণতা। যতই নেশার ঘোরে ‘হুব্বা’ হয়ে যাক, জুয়ার বোর্ডে যতই উপচে পড়ুক টাকার বান্ডিল, রাতটা কোথায়, কোন ঠেকে বা কার বাড়িতে কাটাবে, কেউ জানত না। কাউকে বলত না। দিনের বেলায়ও কোথাও যদি যাওয়ার থাকত কখনও, সময়টা নির্দিষ্ট করে জানাত না কোনও অবস্থাতেই। বলত, বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে যাব। বা চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে। এবং ওই সময়টায় হয়তো যেতই না আদৌ। যেত ওই সময়সীমার আগে-পরে।
সময়ের এই সামান্য হেরফেরেই পাকা খবর থাকা সত্ত্বেও মহেশতলার রেইডটায় এসডিপিও-র নাগাল থেকে বেরিয়ে গেছিল শ্যামল। শুরুতে বলেছি সেই ব্যর্থ রেইডের কথা। লিখেছি, খবরটা যে দিয়েছিল, এসডিপিও-র সেই সোর্সের দেহ দিনদশেক পর পাওয়া গিয়েছিল রিষড়া স্টেশনের কাছে। বাড়িতে ঢুকে মায়ের সামনে কুপিয়ে শ্যামল ভয়ংকরতম বদলা নিয়েছিল পুলিশকে খবর দেওয়ার। এবং রাতে মদের ঠেকে রসিয়ে রসিয়ে বিবরণ দিয়েছিল খুনের, ‘আড়াআড়ি নামিয়ে দিয়েছি। চিরে গেছে পুরো। ঘাড় থেকে কোমর অবধি। আর মালটাকে কুপিয়েছি ওর মায়ের সামনে। পুরো পৈতে করে দিয়েছি বডিটাকে।’
কখনও ‘পৈতে’। কখনও ‘ফুটবল মাঠ’। কখনও ‘বোটি কাবাব’। এক একরকম খুনের বর্ণনায় এক একরকম বিশেষণ ব্যবহার করত শ্যামল। টুকরো টুকরো করে কাটলে সেটা ‘বোটি কাবাব’। পেট চিরে দিয়ে ভিতরে নুড়িপাথর আর ঘাস ভরে দিলে সেটা ‘ফুটবল মাঠ’। মোট কত খুন করেছিল শ্যামল? সরকারি হিসেবই যদি ধরি শুধু, ১৯৯৬-২০০০-এর মধ্যেই অন্তত কুড়িটা খুনের ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিল। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আটের দশকের শেষ থেকে ধরলে, তা নিয়ে জল্পনাই করা যেতে পারে শুধু। তিরিশ? চল্লিশ? নাকি আরও অনেক বেশি?
পুলিশের নাগালের বাইরে থাকার নেপথ্যে পঞ্চম এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, শ্যামলের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, দুরন্ত উপস্থিত বুদ্ধি এবং চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। বিভিন্ন সময়ে শ্যামলের টিমের যে ছেলেপুলেরা ধরা পড়ত, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ পুলিশকে বুঝিয়ে দিত, অন্যদের থেকে ঠিক কোথায় আলাদা ক্লাস থ্রি অবধি বিদ্যের ‘অশিক্ষিত’ শ্যামল।
টুকরো কিছু ঘটনার উল্লেখ থাক। সেবক সংঘের মাঠে ঠেক বসেছে। তখন শ্যামল কুড়ি-বাইশ। চাঁদনি রাত। এক সঙ্গী একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল দু’-তিন পেগ পেটে পড়ার পর, ‘কী অ্যাটমোসফেয়ার মাইরি। মনেই হচ্ছে না এটা রিষড়া! তাজমহলে বসে মাল খাচ্ছি মনে হচ্ছে, বল?’ শ্যামল শুনে সরলভাবেই প্রশ্ন করল, ‘তাজমহল? এই বারটা আবার কোথায়? নতুন হল নাকি?’ সঙ্গীরা হাসিতে ফেটে পড়ত, ‘তাজমহলের নাম শুনিসনি? আরে বার নয় রে !’ অপ্রতিভ দেখাত শ্যামলকে।
অথচ তাজমহলেরও নাম-না-শোনা এই শ্যামলই তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষিত বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিত যখন-তখন। ওই সেবক সংঘ মাঠেরই একটা ঘটনায় যেমন। বেশ কয়েকটা হারিকেনের আলোয় চলছে খানাপিনা। হঠাৎই শ্যামল বলে উঠল, ‘এই, আলো বন্ধ কর, পুলিশ আসছে!’ অন্যরা অবাক। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। কিচ্ছু নেই। কী করে বুঝল পুলিশ আসছে? আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। আর তার ঠিক মিনিট দেড়েক পরে মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে গেল একটা। চলে যাওয়ার পর আবার যখন চালু হল মদ-মাংস, বাকিরা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে বুঝলি?’