বাস্তবেও তাই। ফেলুদা সত্যি, ব্যোমকেশ সত্যি। মিতিনমাসিও সত্যি।
৭. সিনেমাতেও এমন হয় না
এভাবেও গোল খাওয়া যায়?
ফুল টাইম হয়ে গিয়েছিল। যে কোনও সময় শেষের বাঁশি বাজত। ইনজুরি টাইমের দু’-তিন মিনিট খেলাচ্ছিল রেফারি। ঘড়ি দেখছিল বারবার। ওই সময় এই গোল কেউ খায়! যে ম্যাচ ওয়ান-অল শেষ হওয়ার কথা, সেটা কেউ এভাবে টু-ওয়ানে হারে? সব দোষ বুবাইয়ের। অপোনেন্ট অল আউট ঝাঁপাচ্ছে গোলের জন্য, তখন কেউ ওভাবে ডিফেন্স চিচিং ফাঁক করে ওভারল্যাপে যায়?
আর গেলি তো গেলি, অ্যাট লিস্ট বলটা হোল্ড তো কর! মাঝমাঠ পেরতে না পেরতেই কড়া ট্যাকলে বল কেড়ে নিল বুবলা, ‘তরুণ সংঘের’ মিডফিল্ডার। লহমায় উঠে এল উইং দিয়ে। বুবলার নিখুঁত ক্রসে নিটোল হেড রিন্টুর। গোল। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ওঠার গল্প শেষ। টু-ওয়ানে হেরে ছিটকে যাওয়া।
পাপ্পা আজ ডিফেন্সে থাকলে হত না এটা। ঠিক সামলে দিত। রিন্টুকে নিতেই দিত না হেডটা। ছিটকে দিত শোল্ডার-পুশে। এরিয়াল বলে পাপ্পাকে বিট করা অত সোজা নয়। আজ পাপ্পা থাকলে…।
শেষ মিনিটে হেরে যাওয়া ম্যাচের পোস্টমর্টেম চলছিল। ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেও নাগেরবাজারের মাঠে মুহ্যমান বসেছিল ‘দমদম ইয়ুথ স্পোর্টিং ক্লাব’-এর পাঁচ কিশোর।
যে থাকলে এই ম্যাচ এভাবে হারতে হত না বলে সমবেত আক্ষেপ, সেই পাপ্পাকে দেখা গেল এই সন্ধের মুখে মাঠের দিকে হেঁটে আসতে। কাছাকাছি আসতেই টোটো বলে ফেলল, ‘এতক্ষণে সময় হল বাবুর! তরুণ সংঘ আমাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে যাওয়ার পর!’
টোটোর দেখাদেখি রাজাও কিছু বলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল পাপ্পাকে দেখে। যার চোখমুখ অস্বাভাবিক রকমের থমথমে আজ। গনগনে রাগ যেন জমাট বেঁধে আছে চেহারায়।
‘কী রে… এভাবে ঝোলালি আজ… লাস্ট মিনিটে হেরে গেলাম…’, দেবা, মানে দেবাশিষ শুধু এটুকু বলেছিল। তাতেই ফেটে পড়ল পাপ্পা, ‘কী করে আসব? শালা বাড়ি থেকে আসতে দিলে তো! বাবা, ওই ডাইনিটা আর দাদার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেল আফটারনুন শো-য়ে। এই ফিরেছে একটু আগে।
‘আমি বলেছিলাম, আজ কোয়ার্টার ফাইনাল, ম্যাচটা খেলেই চলে আসব। বাবা বলল, ‘‘ওয়ার্ল্ড কাপ হচ্ছে বুঝি? পাতি পাড়ার ম্যাচ কিছু বখাটে ছোঁড়ার সঙ্গে, তা নিয়ে এত কথার কী আছে? পেলে বা মারাদোনা হবি নাকি বল পিটিয়ে?’’ ডাইনিটাও তাল দিল সঙ্গে সঙ্গে। বলল, ‘‘ফুটবল নিয়ে অত নখরা করতে হবে না, আমরা ফেরার আগে দুপুরের বাসনগুলো মেজে রাখবি। আর হ্যাঁ, কাজলের জামাকাপড়গুলো গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখবি। একটুও এদিক-ওদিক হলে মজা দেখাব।’’
দাদাও এত শয়তান, বেরনোর আগে হাসতে হাসতে বলে গেল, ‘‘পাপ্পা, গুছিয়ে রাখিস কিন্তু সব। না হলে শুনলি তো, মা ফিরে এসে মজা দেখাবে।’’ দাদার কথায় আমার মাথায় আগুন চড়ে গেল। তেড়ে গেলাম। বাবা তাই দেখে বেদম মারল। এই দ্যাখ, দাগ হয়ে গেছে গায়ে। যখন মার খাচ্ছিলাম, দাদা দাঁত ক্যালাচ্ছিল। ডাইনিটাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। আমার ইচ্ছে করছিল গলা টিপে মেরে ফেলি সব ক’টাকে।’
পাড়াতুতো টুর্নামেন্টের হারজিতের সমস্যা গৌণ হয়ে যায় নিমেষে। বন্ধুরা অসম্ভব ভালবাসে পাপ্পাকে। ওরা জানে, বাড়িতে ঘোর অশান্তিতে কাটে পাপ্পার দিনগুলো। জানে, বাড়িটার রিমোট কন্ট্রোল থাকে ওর সৎমায়ের কাছে। প্রথম স্ত্রীর কথাতেই ওঠে-বসে পাপ্পার বাবা। সৎদাদা কাজল বাড়িতে থাকে রাজার হালে। আর পাপ্পার দিন কাটে চাকরের মতো। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির হাজারটা কাজ করতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই বাবার কাছে নালিশ ঠোকে সৎমা। আর পিটুনি খায় পাপ্পা। একটাও শখ-আহ্লাদ মেটে না ছেলেটার। আজ যেমন। সেই বাচ্চা বয়স থেকেই পাপ্পা ফুটবল বলতে অজ্ঞান। খেলেও দারুণ। অথচ আজকের ভাইটাল ম্যাচটা খেলতে পারল না।
টোটো পিঠে হাত রাখে পাপ্পার, ‘ছাড়… মন খারাপ করিস না। পরের মাসে শুনলাম বিরাটির দিকে একটা সেভেন-আ-সাইড টুর্নামেন্ট নামাচ্ছে ওখানের একটা ক্লাব। দেখিস, ওটায় ঠিক জিতব আমরা। এই তরুণ সংঘ-র সঙ্গে হিসেবটা মিটিয়ে দেব।’
পাপ্পার প্রতিক্রিয়ায় খানিক ঘাবড়েই যায় বন্ধুরা, ‘তার আগে আমাকে বাড়ির হিসেবটা মিটিয়ে ফেলতে হবে। অনেক ভেবে দেখেছি। এভাবে লাথিঝাঁটা খেয়ে থাকব না আর আমি। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।’
রঞ্জিত উত্তেজিতভাবে বলে, ‘সত্যিই… সহ্য করা উচিতও নয়… কেলিয়ে কলাগাছ করে দেওয়া উচিত… বাড়ির কুকুর-ছাগলের সঙ্গেও লোকে এই ব্যবহার করে না… তোর বাপটা মাইরি আজব পাবলিক!’
‘যা বলেছিস!’ দেবাশিষ যোগ দেয় আলোচনায়, ‘নষ্টের গোড়া কিন্তু তোর বাবাই… না হলে তোর ওই সৎমা-র সাহস হত এভাবে অত্যাচার করার? মিলিয়ে নিস, তোর বাবাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে তোর দাদার নামে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেবে তোর সৎমা। কানাকড়িও জুটবে না তোর ভাগ্যে।’
পাপ্পা শুনছিল চুপচাপ। রাজা পাশে এসে বসল, ‘এই যে বললি বাড়ির হিসেব মিটিয়ে দিবি…মানে?’
—মানে আবার কী? হিসেব মিটিয়ে দেওয়ার যা মানে, তাই।
টোটোকে অধৈর্য শোনাল, ‘হেঁয়ালি করিস না!’
পাপ্পা তাকাল বন্ধুদের মুখের দিকে। রাজা-টোটো-বুড়ো-দেবা-রঞ্জিত… এরা তার ছোটবেলার বন্ধু। প্রাণের-মনের সব কথা একমাত্র ওদেরই বলতে পারে সে। ওদের তো বলতেই হবে সব। একা হবে না কাজটা। বন্ধুদের হেল্প লাগবেই। আপাতত অবশ্য একটাই জিনিস জানার আছে ওদের কাছে।