সুপ্রিম কোর্টের যাবতীয় শর্ত অক্ষরে অক্ষরে মেনে ফের শুরু হল নতুন করে জুডিথের সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়া। প্রতিদিনই সুজয়ের সঙ্গে আদালতে হাজির থাকতেন তাঁর মা। একদিনও বাদ যেত না, ছেলের পাশে থাকতেন আগাগোড়া। সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়ায় মাঝেমাঝেই ‘মেন্টাল ব্রেকডাউন’ হত জুডিথের। ক্যামেরার দিকে মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে ফের নামিয়ে নিতেন। কেঁদেও ফেলতেন কখনও কখনও।
গৌরী-তৃষ্ণা লক্ষ করছিলেন, ‘আইডেন্টিফিকেশন অফ দ্য অ্যাকিউজ়ড’ বা অভিযুক্তের চিহ্নিতকরণের দিন যত এগিয়ে আসছিল, নিজের চেহারায় সচেতনভাবে বদল আনছিলেন সুজয়। ‘ক্লিন-শেভড’ ছিলেন ঘটনার সময়। হঠাৎই দাড়িগোঁফ রাখতে শুরু করলেন । চুল কাটা বন্ধ করে দিলেন। ‘হিপি’-দের মতো চেহারা করে ফেললেন। ঘটনার সময়ের চেহারার সঙ্গে যাকে মেলানো দায়। অঙ্ক পরিষ্কার, চেহারাকে এতটাই ভাঙচুর করা, যাতে চিহ্নিতকরণের দিন ‘আইডেন্টিফাই’ করতে অসুবিধা হয় জুডিথের। যিনি সুজয়কে দেখেছিলেন মাত্র সাত-আট ঘণ্টার জন্য। তারপর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে বছর চারেক।
চিহ্নিতকরণের দিন যা ঘটল, ধরা থাক তৃষ্ণার জবানিতে, ‘ভীষণ টেনশনে ছিলাম আমরা। এতদিনে আমাদেরও এনার্জি ফুরিয়ে এসেছিল প্রায়। শুধু ভাবছিলাম শেষরক্ষা হবে তো? কয়েক মাস চুল-দাড়ি না কেটে একটা কিম্ভূত চেহারা করে ফেলেছিল সুজয়। বিচারক সেদিন মাত্র চোদ্দো-পনেরো জনকে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন ভিসি-রুমে। দু’পক্ষের আইনজীবী মিলিয়ে চারজন। আমি আর গৌরী। কোর্টের কর্মী পাঁচজন। এনআইসি-র দু’জন আধিকারিক। আর সুজয়। নির্দেশ ছিল, আইনজীবীরাও থাকবেন সাদা পোশাকে। প্রথাগত কালো গাউন পরে নয়। ঠিক পৌনে তিনটেয় ভিসি চালু হল। জুডিথকে দেখে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল। আমরা শুধু ভাবছিলাম, পারবে তো?
‘ক্যামেরা চলতে শুরু করল। বিচারক কোনও বাড়তি কথায় গেলেন না। সোজাসুজি বললেন, এই ঘরে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেককে ভাল করে দেখুন। এবং দেখে বলুন, এঁদের মধ্যে কি সেই ব্যক্তি আছেন, যাঁর বিরুদ্ধে আপনি ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন? ভাল করে দেখুন। কোনও তাড়া নেই।
‘সুজয় সেদিন সাদা শার্ট পরে এসেছিল। ক্যামেরা ধীরে ধীরে জ়ুম করছিল ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকের মুখের উপর। সুজয়ের মুখের উপর থেকে যেই ক্যামেরা সরে ফোকাস করল বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর উপর, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল জুডিথ, ‘‘হোল্ড ইট! ব্যাক প্লিজ়!’’ ক্যামেরা ফিরল সুজয়ের মুখের উপর। সুজয় মুখ তুলছিল না। বিচারক ধমক দিলেন, ‘‘মুখ তুলুন!’’ ঘরে একটা দমবন্ধ অবস্থা তখন। সেকেন্ড দশেক বড়জোর, জুডিথ ফের চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘ইটস হিম ! দ্য ওয়ান ইন দ্য হোয়াইট শার্ট!’’ বলেই ফের মুখ নিচু করে কেঁদে ফেললেন, ‘‘ক্যান উই এন্ড দিস নাউ?’’ একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। নিশ্চিত হয়ে গেলাম, কনভিকশন এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।’
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের বিস্তারিত দিনপঞ্জি দিয়ে দীর্ঘায়িত করছি না এ-লেখার কলেবর। তবে এটুকু অবশ্যই উল্লেখ্য, যে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি খুব বেশি হলে এক বা দেড় বছরের মধ্যে হয়ে যাবে বলে ভেবেছিলেন লালবাজারের কর্তারা, বিস্তর টানাপোড়েনের বাধা পেরিয়ে তার রায় বেরিয়েছিল প্রায় সাড়ে চার বছর পরে। ২০১৮-র জানুয়ারিতে। আলিপুর আদালত সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল সুজয় মিত্রকে। জরিমানা বাবদ জুডিথকে দুই লক্ষ টাকা দেওয়ারও নির্দেশ ছিল সুজয়ের উপর।
‘জাস্টিস ডিলেইড’ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ‘ডিনায়েড’ হয়নি। গৌরী-তৃষ্ণা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে দেননি ভারতে এসে যৌন-নির্যাতনের শিকার হওয়া এক বিদেশিনীকে। বিচারপ্রক্রিয়ায় তদন্তকারীদের মরিয়া লড়াই আর নিরলস অধ্যবসায়ের জন্যই গোয়েন্দাপীঠ লালবাজারের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে এই মামলা।
কল্পনার গোয়েন্দা কাহিনিতে সংখ্যার নিরিখে হোক বা জনপ্রিয়তায়, মহিলা ডিটেকটিভের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা। বিদেশি গোয়েন্দা সাহিত্যে এক এবং অদ্বিতীয়া আগাথা ক্রিস্টি সৃষ্ট মিস মার্পল। বাংলায় মুখ ফেরাই যদি, আছেন অনেকে। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ‘কৃষ্ণা’ থেকে মনোজ সেনের ‘দময়ন্তী’। প্রদীপ্ত রায়ের ‘জগাপিসি’ থেকে নলিনী রায়ের ‘গন্ডালু,’ বা অদ্রীশ বর্ধনের ‘নারায়ণী’। তবে লোকপ্রিয়তার মাপকাঠিতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘মিতিনমাসি’ বা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা গার্গী’ অনেকটাই এগিয়ে অন্যদের তুলনায়। অনেকেরই স্বাভাবিক কৌতূহল, বাস্তবে নেই মহিলা গোয়েন্দা? পুরুষদেরই আধিপত্য একচেটিয়া?
সত্যের খাতিরে স্বীকার্য, আধিপত্য হয়তো আছে। হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই আছে। কিন্তু তা মহিলা গোয়েন্দাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো নিরঙ্কুশ নয় মোটেই। মেধা, পরিশ্রম এবং আন্তরিকতার ত্র্যহস্পর্শে বহু জটিল মামলার সুচারু সমাধান করেছেন মহিলা অফিসাররা। আলোচ্য কেস তো একটা নমুনা মাত্র।
এ কাহিনির শেষ অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মনে পড়ে যায়। ছবির একদম শুরুতে রুকু ওরফে ক্যাপ্টেন স্পার্কের সেই ডায়লগটা ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসে অনিবার্য। ‘সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, টারজান সত্যি, অরণ্যদেব সত্যি…।’