এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সাক্ষী দেওয়ার সময় একজন ধর্ষিতা ক্যামেরার দিকে কতটা তাকালেন বা না তাকালেন, সেটা মোটেই গ্রাহ্য নয় সাক্ষ্যের গুরুত্ব নির্ধারণে। একজন ‘রেপ-ভিক্টিম’-এর পক্ষে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় ‘ট্রমাটাইজ়ড’ থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। অতএব যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দৈনিক ভিত্তিতে শেষ করতে হবে জুডিথের সাক্ষ্যদান।
হাইকোর্টের রায় বেরনোর যা অপেক্ষা! সুজয়ের আইনজীবীরা রায়ের বিপক্ষে দ্রুত আবেদন করলেন সুপ্রিম কোর্টে। সুজয়দের পরিবার যথেষ্ট অর্থবান। নামজাদা উকিলদের পিছনে জলের মতো টাকা খরচ করাটা কোনও সমস্যাই নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ফের শুরু হল যুক্তি-পালটা যুক্তির আইনি লড়াই।
একটা ব্যাপার পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চিত লক্ষ করবেন। এই যে লিখছি, নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন হল হাইকোর্টে, রায় বহাল রাখল হাইকোর্ট, ফের আবেদন হল সুপ্রিম কোর্টে…ঘটনা-পরম্পরা ধরা থাকছে মাত্র কয়েকটা অনুচ্ছেদে। পড়লে হয়তো মনে হবে,ও আচ্ছা, এটার পর ওটা ঘটল। আর ওটার পর সেটা। বাস্তবের বিচারপর্ব সিনেমার ‘কোর্টরুম ড্রামা’ নয়। বরং, বিলম্বিত লয়। এটা-ওটা-সেটার যাত্রাপথে সময় কীভাবে চলে যায়, তদন্তকারীরাই জানেন। হাজার হাজার বিচারাধীন মামলা। হরেক তাদের চেহারা, হরেক তাদের চরিত্র। একটা নির্দিষ্ট মামলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও স্রেফ সংখ্যার চাপে উপায় হয় না আদালতের। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়, ক্যালেন্ডারে পালটে যায় বছর।
এবং ঠিক এখানেই তদন্তকারী অফিসারদের সিলেবাসে কঠিনতম চ্যাপ্টারের প্রবেশ। ধৈর্যের অনন্ত পরীক্ষা, অধ্যবসায়ের শেষ সীমান্ত ছুঁয়ে আসার চ্যালেঞ্জ। মগজাস্ত্রের প্রয়োগে কেসের সমাধান তো সিঁড়ির একটা ধাপ স্রেফ। জটিল মামলার বিচারপর্বে দাঁত কামড়ে লেগে থাকা তার থেকেও ঢের বেশি কঠিন।
গৌরী এবং তৃষ্ণা প্রাণপণ লড়ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ধেয়ে আসা বাউন্সারকে ‘ডাক’ করে পড়ে ছিলেন পিচ আঁকড়ে। উভয় পক্ষের তার্কিক স্নায়ুযুদ্ধ যখন চলছে সুপ্রিম কোর্টে, শুনানির পর শুনানিতে সুজয়ের আইনজীবীরা সাজাচ্ছেন ভিসি-প্রক্রিয়া বাতিল করার যুক্তিজাল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ দিল্লিতে কাটিয়েছিলেন গোয়েন্দাবিভাগের এই দুই মেধাবিনী তদন্তকারী। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করে সাজিয়েছিলেন পালটা যুক্তি। যখন সুপ্রিম কোর্টে জারি এই মামলার চাপান-উতোর, তার মাসখানেক আগেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন তৃষ্ণা। সামনে ছিল ছেলের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। গৌরীর বাবাও সেই সময়েই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবশ্য কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর দায়বদ্ধতা কবেই বা গ্রাহ্য করেছে সময়-অসময়-দুঃসময়কে?
রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। যে রায়ে খুশি হওয়ার কারণ ছিল। হতাশ হওয়ারও।
খুশি, কারণ সুপ্রিম কোর্ট শর্তাধীন বৈধতা দিল ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জুডিথের সাক্ষ্যদানকে। কী শর্ত?
(ক) রাজ্য সরকারকে এনআইসি-র সহায়তা নিয়ে ‘VC Location’ নামক সফ্টওয়ারের মাধ্যমে ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এনআইসি এ বিষয়ে আয়ারল্যান্ডে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলবে এবং সুনিশ্চিত করবে উভয় পক্ষের প্রযুক্তিগত সাযুজ্য। আলিপুর কোর্টের বিচারক একটি বিশেষ ঘর চিহ্নিত করবেন, যেখানে চলবে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। এজলাসে নয়, অন্য কোনও নির্দিষ্ট ঘরে।
(খ) আয়ারল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাস একজন দায়িত্বশীল আধিকারিককে চিহ্নিত করবে। সাক্ষ্যগ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র জুডিথের সঙ্গে দূতাবাসে ভিসি-র জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে থাকবেন এবং নিশ্চিত করবেন কোনও তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতি। এবং এই শর্তগুলো যে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে সে ব্যাপারে সাক্ষ্যগ্রহণের আগে কোর্টকে লিখিত হলফনামা দেবেন সংশ্লিষ্ট অফিসার।
(গ) সাক্ষ্যদানে যে যে প্রশ্নের উত্তরে যা যা বললেন জুডিথ, পুরোটা স্ক্যান করে মেইল করতে হবে আইরিশ এমব্যাসিতে। জুডিথ সেটা পড়ে দেখে নেবেন, বয়ান নথিভুক্ত করায় কোনও ভুলভ্রান্তি হয়েছে কিনা। তারপর বয়ানে সই করবেন এবং সেই স্বাক্ষরিত বয়ানের এক কপি স্ক্যান করে মেইল করতে হবে আলিপুর কোর্টে। আর একটা কপি থাকবে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসারের কাছে। বন্ধ খামে।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু খুশির পাশাপাশি হতাশারও উদ্রেক করল সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের শেষাংশ। যাতে বলা হল স্পষ্ট, এ যাবৎ জুডিথের যা সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা হল। নতুন করে শুরু হবে সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়া, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের শর্তাবলি মেনে, ‘The instant parameters have to be adopted to record the testimony of the prosecutrix-PW 5, in addition to the procedure and safeguards provided for in the impugned order. Accordingly, it will be imperative to record her testimony afresh.’
মানে? ফের শূন্য থাকে শুরু? নিম্ন আদালতে এত যে কাঠখড় পোড়ানো, কলকাতা-দিল্লিতে এত যে দৌড়ঝাঁপ, এত যে মেইল-চালাচালি, সব কিছুর নিট ফল শেষমেশ এই? এ তো অনেকটা সেইরকম হল, বল উইকেটে লাগল, কিন্তু বেল পড়ল না। নট আউট! আবার ফিরে যাও বোলিং রান-আপে। শুরু করো নতুন করে। কী আর করা, ভাবলেন তৃষ্ণারা। শেষ পর্যন্ত দেখাই যাক। এত কাছে এসে ফিরে যেতে নেই।