জুডিথের সম্মতি পাওয়ামাত্র জানানো হল আলিপুর কোর্টে। অনুমতি চাওয়া হল ভিসি-র মাধ্যমে জুডিথের সাক্ষ্যদানের । আদালত সম্মত হল, সরকার পক্ষের আইনজীবীকে নির্দেশ দিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে। সঙ্গে সঙ্গে লালবাজার থেকে চিঠি গেল রাজ্য সরকারের আইনমন্ত্রকে। অনুরোধ, সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতর যেন সাহায্য করে আদালতে ভিসি-র প্রক্রিয়ার সুবন্দোবস্তে। তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী তৃষ্ণা-গৌরী ছুটলেন ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার (এনআইসি)-এ। ঠিক কী কী দরকার হবে আদালতে , পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা দিল এনআইসি।
লালবাজারের কম্পিউটার সেল, টেলিফোন বিভাগ, ওয়ারলেস দফতরের যৌথ সমন্বয়ে দ্রুতই তৈরি হয়ে গেল পরিকাঠামো। কম্পিউটার, প্রোজেক্টর-স্ক্রিন, স্পিকার-মাউথপিস, ফোর জি ডঙ্গেল… যা যা দরকার। খুব বেশি তো কিছু লাগে না একটা ভিসি-র আয়োজনে ।
জুডিথকে একটা ‘স্কাইপ’ অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হল। লালবাজারের ‘উইমেন্স গ্রিভান্স সেল’-ও অ্যাকাউন্ট খুলল স্কাইপে। আদালতের নির্দেশে সাক্ষ্যগ্রহণের দিনগুলিতে জুডিথকে আয়ারল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাসে উপস্থিত থাকতে বলা হল। সময়টা নির্ধারিত হল দু’দেশের ‘টাইম ডিফারেন্স’ মাথায় রেখে। আমাদের যখন সকাল দশটা, আয়ারল্যান্ডে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। ভারত সাড়ে চার ঘণ্টা এগিয়ে। জুডিথকে অনুরোধ করা হল আইরিশ সময় সকাল দশটায় দূতাবাসে আসতে। যাতে দুপুর আড়াইটে থেকে টানা সাক্ষ্য নেওয়া যায় কোর্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ।
গোয়েন্দাবিভাগ এবং এনআইসি-র টেকনিক্যাল টিম সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার পর বিচারক নিজে খুঁটিয়ে দেখলেন সবটা। এবং নির্দিষ্ট দিনে ভিডিয়ো-কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হল আলিপুর টু আয়ারল্যান্ড। শুরু হল জুডিথ ফ্লোরেন্সের সাক্ষ্যগ্রহণ। জুডিথের সঙ্গে উপস্থিত থাকলেন আয়ারল্যান্ডে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি বেঞ্জামিন বেসরা। বিচারকের কাছে সরকারি আইনজীবী বিচারপর্বের শুরুতেই আবেদন করেছিলেন, মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী যেন জুডিথের সাক্ষ্যদান পর্ব তাড়াতাড়ি শেষ করা হয়। সম্মত হয়েছিলেন বিচারক।
তিন দফায়, দিন পনেরোর মধ্যেই প্রায় শেষ হয়ে এল জুডিথের ‘একজামিনেশন-ইন-চিফ’, (সাক্ষীকে বাদীপক্ষের উকিলের জেরা, যার উদ্দেশ্য হল প্রশ্নমালা সাজিয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের সারবত্তা প্রমাণ করা)। এরপর পালা ‘ক্রস-একজামিনেশন’-এর, যখন বিবাদী পক্ষের উকিলের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে জুডিথকে। যতই চেষ্টা করুন অভিযুক্তের আইনজীবীরা, তথ্যপ্রমাণের জাল কাটিয়ে সুজয়ের বেরনো অসম্ভব, আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তৃষ্ণা-গৌরীরা। সেই বিশ্বাস সামান্য টোল খেল, যখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুজয়ের আইনজীবী ‘ক্রস-একজামিনেশন’-এর আগেই পিটিশন করলেন কোর্টে। পিটিশনের সারবস্তু? ধর্ষণের এই মামলায় এভাবে ভিসি-র মাধ্যমে অভিযোগকারিণীর সাক্ষ্যগ্রহণের আইনি বৈধতা নেই। প্রক্রিয়াটাই তাই বাতিল করা হোক।
বাতিল করার সপক্ষে যুক্তি সাজালেন সুজয়ের আইনজীবী। এক, বিচারপর্বে হাজির থাকার জন্য সমন পাঠানো হয়নি জুডিথকে। দুই, যিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তিনিই যে অভিযোগকারিণী, সে ব্যাপারে ওকালতনামা জমা নেওয়া উচিত ছিল কোর্টের। নেওয়া হয়নি। তিন, সাক্ষ্যগ্রহণের সময় জুডিথ এবং ভারতীয় দূতাবাসের অফিসার ছাড়া অন্য কেউ যে উপস্থিত থাকছেন না, সেটা নিশ্চিত করা হয়নি। হতেই পারে, ওই ঘরে অন্য কেউ থাকছেন, যিনি ক্যামেরার আড়ালে থেকে জুডিথকে ইশারায় নির্দেশ দিচ্ছেন। চার, কথা বলার সময় ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছেনই না জুডিথ। সাক্ষীর শরীরী ভাষা স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়াটাও সাক্ষ্যমূল্য নির্ধারণের একটা শর্ত। সেই শর্ত পালিত হচ্ছে না।
আলিপুর কোর্ট মানল না এই যুক্তি। প্রশ্ন তুলল পালটা, এইসব ওজর-আপত্তি আগে তোলেননি কেন বিবাদী পক্ষের উকিল? প্রক্রিয়াগত ত্রুটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন প্রক্রিয়া অনেকটা সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর? মানা যায় না এই হঠাৎ বোধোদয়। সুতরাং যেমন চলছে, তেমনই চলবে।
যেমন চলছিল, তেমন আর চলল কই? বিবাদী পক্ষ পত্রপাঠ দ্বারস্থ হল হাইকোর্টের। সওয়াল-জবাব পর্ব শেষ হওয়ার পর উচ্চ আদালতও খারিজ করে দিল সুজয়ের আইনজীবীদের দাবি।
খারিজ করার কারণ?
প্রথমত, সমন জারি করে আদালতে বিদেশিনী সাক্ষীর সশরীরে হাজিরা শুধু সময়সাপেক্ষই নয়, অনিশ্চিতও। ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং প্রক্রিয়ায় দেশে সাক্ষ্যদান হয়েছে একাধিক। অধিকাংশই যদিও দেওয়ানি মামলায়, ফৌজদারি মামলাতেও নজির আছে। ধর্ষণের মতো গুরুতর মামলায় এ যাবৎ হয়নি ঠিকই , কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে যে-কোনও কেসেই ভিসি-প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যদানে কোনও আইনি বাধা নেই।
দ্বিতীয়ত, সাক্ষ্যদানের সময় ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি উপস্থিত ছিলেন, যিনি ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের দায়িত্বশীল অফিসার। তিনি অবশ্যই এটুকু নিশ্চিত করেছেন যে জুডিথের হয়ে অন্য কেউ সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। জুডিথের ছবি আছে কেস ডায়েরিতে। সেই ছবির সঙ্গে বাস্তবের সাক্ষীর ন্যূনতম অমিলও খুঁজে পাননি নিম্ন আদালতের বিচারক। এই জুডিথই সেই জুডিথ কিনা, সেই প্রশ্ন তোলা তাই হাস্যকর। এবং ফার্স্ট সেক্রেটারির উপর এটুকু ভরসাও রাখতেই হবে যে তিনি জুডিথ ছাড়া অন্য কোনও তৃতীয় ব্যক্তিকে উপস্থিত থাকতে দেননি সাক্ষ্যদানের সময়।