এবার? ধর্ষণের মামলায় অভিযোগকারিণীর সাক্ষ্যদান এবং অভিযুক্তকে চিহ্নিতকরণ একেবারে ন্যূনতম পূর্বশর্ত। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে এ মামলার নিষ্পত্তি অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। দীর্ঘ বেঠকে বসলেন জয়েন্ট কমিশনার( ক্রাইম)। যে বৈঠকে জুডিথের অসহযোগিতা নিয়ে ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না তদন্তকারী টিমের অফিসাররা।
রীতিমতো হতাশই শোনাচ্ছিল তৃষ্ণাকে, ‘এভাবে হয় স্যার, বলুন? বারবার বললাম, জাস্ট দু’সপ্তাহের জন্য আসুন। কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। ভিক্টিমের এগজামিনেশন না হলে তো মামলা বিশ বাঁও জলে চলে যাবে।’
গৌরীও যোগ দিলেন আলোচনায়, ‘একজ়্যাক্টলি। একদিকে ওদের এমব্যাসি থেকে চিঠি এসেই চলেছে কেসের প্রোগ্রেস জানতে চেয়ে, অথচ ভিক্টিম কোর্টে সাক্ষী দিতে আসবে না! এটা কিন্তু আনফেয়ার স্যার। জাস্টিস দেওয়ার জন্য আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছি আমরা, এভিডেন্স যা আছে, কনভিকশন হবেই। কিন্তু জাস্টিস পেতে গেলে ভিক্টিমকেও তো মিনিমাম কো-অপারেশন করতে হবে!’
পৃথ্বীরাজও ক্ষোভ গোপন করলেন না, ‘সেটাই। মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপে জানা নেই-শোনা নেই, এমন দু’জন লোককে বিশ্বাস করে কেউ ওভাবে অত রাতে বেরিয়ে যায়? কই, আর কেউ তো যায়নি। বন্ধুদের সঙ্গে হোটেলে ফিরে গেলে ঘটনাটাই ঘটত না। আর ঘটে যখন গেছেই, কালপ্রিটের শাস্তি নিশ্চিত করতে আর একবার আসা যায় না ট্রায়ালের সময়? আমরা কার জন্য এত কিছু করছি? জুডিথের জন্যই তো! কিছু মনে করবেন না স্যার, সেই রাতে জুডিথ নির্বোধের মতো কাজ করেছিলেন। আর এখন অন্যায় জেদ করছেন।’
গোয়েন্দাপ্রধান চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষণ। বুঝছিলেন,অফিসারদের যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ক্ষোভও নয় পুরোপুরি অসংগত। সব শোনার পর মুখ খুললেন।
‘একটা ব্যাপার বোঝো। জোর করে তো আমরা জুডিথকে ভারতে আসতে বাধ্য করতে পারব না। ‘‘আসবে না’’ ধরে নিয়েই অন্য রাস্তা ভাবতে হবে। আর শোনো, সেদিন রাতে জুডিথের আচরণ নিয়ে জাজমেন্টাল না হওয়াই ভাল। বোকামি তো নিশ্চয়ই করেছিল মেয়েটি। আর তার চরম মূল্যও চোকাতে হয়েছে। আসলে কী জানো, এই কুড়ি-একুশ বয়সটা অদ্ভুত। বিপদকে অ্যান্টিসিপেট করতে পারলেও সাধারণত বিশ্বাস করতেই বেশি উৎসুক থাকে ওই বয়সিরা। কাকে কখন বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা উচিত, সেই বোধটা খুব পরিষ্কারভাবে ঠিক তৈরি হয় না। বিশ্বাস করার মাশুল এভাবে দিতে হবে জানলে কি আর যেত?’
‘মানলাম স্যার’, তৃষ্ণা বলে ওঠেন, ‘কিন্তু বিদেশবিভুঁইয়ে আরও অনেক বেশি কেয়ারফুল থাকা উচিত ছিল। সমাজসেবা করতে এসে…’
গোয়েন্দাপ্রধান থামিয়ে দেন তৃষ্ণাকে, ‘সে তো একশোবার। কেয়ারফুল ছিল না বলেই তো এত কিছু। কিন্তু ওই যে বললাম, বয়সটাই ঝুঁকি নেওয়ার। আর ভুলে যেয়ো না, শি ওয়াজ় ড্রাঙ্ক। আর একটা কথা, সমাজসেবা করতে এসেছিল একটা প্যাশন থেকে। তার সঙ্গে তো বন্ধুদের নিয়ে হইহুল্লোড় করার কোনও বিরোধ নেই। মাদার টেরিজার সংস্থায় কাজ করতে এসেছিল বলে ওকেই মাদার টেরিজা বলে ভেবে নেওয়াটাও বোধহয় আনফেয়ার।’
পৃথ্বীরাজ না বলে পারেন না, ‘তবু স্যার…।’
‘শোনো পৃথ্বীরাজ, আরও একটা বেসিক জিনিস ভুলে যাচ্ছ তোমরা। দুটো সোসাইটির তফাত। ইউরোপ বা আমেরিকায় নারী-পুরুষে ফ্রি-মিক্সিংয়ে কোনও ছুঁতমার্গ নেই। যেটা আমাদের এখানে আছে। আমাদের দেশে গড়পড়তা মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনও মেয়ে অপরিচিত দু’জন পুরুষের সঙ্গে হুট করে মধ্যরাতের পার্টিতে চলে যাওয়ার আগে হাজারবার ভাববে। ইউরোপ-আমেরিকায় মোটেই ভাববে না অতটা। কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ, সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু দুটো সমাজ আলাদা। তাদের ভ্যালুসিস্টেম আলাদা। মাইন্ডসেট আলাদা। এটা তো ভুললে চলবে না। তা ছাড়া জুডিথ তো তোমাদের বলেওছে, কনসেনসুয়াল সেক্স হলে কোনও অসুবিধা ছিল না ওর। ওকে সুজয় ফোর্স করেছিল বলেই কমপ্লেনটা করেছে।’
‘সে তো বুঝলাম স্যার, কিন্তু এখন কেসটার কী গতি হবে?’ তৃষ্ণার চোখেমুখে উদ্বেগ ধরা পড়ছিল।
‘ভেবে দেখলাম, একটাই রাস্তা পড়ে আছে।’ গোয়েন্দাপ্রধান বললেন শান্তভাবে।
‘কী স্যার?’
‘ভিসি। ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং।’
‘ভিডিয়ো–কনফারেন্সিং?’ পৃথ্বীরাজের গলায় ঠিকরে বেরয় সংশয়, ‘রেপ কেসে ভিডিয়ো–কনফারেন্সিং স্যার? ছোটখাটো কেসে ভিসি-র মাধ্যমে ট্রায়াল এর আগে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কিন্তু রেপ কেসে বোধহয় এদেশে ভিসি-ট্রায়াল হয়নি স্যার। আমাদের রাজ্যে তো হয়ইনি। ডিফেন্স প্রচুর ঝামেলা করবে।’
‘জানি। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় আছে কি কোনও? চেষ্টা তো একটা করতেই হবে। সব কিছুরই একটা প্রথমবার থাকে। এই কেসে কনভিকশন না করাতে পারলে শুধু কলকাতা পুলিশ নয়, গোটা রাজ্যের মুখ পুড়বে। দেশেরও। তোমরা কালই জুডিশিয়াল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলো। শেষ না দেখে ছাড়ার প্রশ্নই নেই।’
.
ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং-এর মধ্যস্থতায় অভিযোগকারিণীর সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়া, তা-ও ধর্ষণের মামলায়, দেশে এই প্রথম। না অভিজ্ঞতা ছিল স্থানীয় আদালতের, না পুলিশের।
প্রথম কাজ আইরিশ দূতাবাসে মেল করে প্রস্তাবটা দেওয়ার। জেনে নেওয়া, এই পদ্ধতিতে জুডিথ আদৌ রাজি আছেন কিনা। মেলের উত্তর দিতে বেশ কিছুটা সময় নিলেন জুডিথ। অবশেষে আইরিশ দূতাবাস মারফত জানালেন, রাজি। তাঁর সমস্যা ভারতে আবার আসা নিয়ে। আসতে না হলে যে কোনও প্রক্রিয়ায় পূর্ণ সহযোগিতা করবেন। কোনও আপত্তি নেই।