জানা গিয়েছিল, মাইকেল আদতে ড্রাগ-পেডলার। রাতবিরেতের হাই-প্রোফাইল পার্টিতে বা ক্লাবে চড়া দামে ড্রাগ সরবরাহ করাটাই পেশা। মাইকেলের নাগাল পাওয়া যে কঠিন হবে এবার, বুঝেছিলেন অফিসাররা। ফ্ল্যাটে ‘রেইড’ হয়েছে, খবর ঠিকই পেয়ে যাবে। এবং এমুখো আর হবেই না। মাইকেলকে ধরা অবশ্য পুলিশের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল না। জুডিথ কোনও অভিযোগ করেননি মাইকেলের বিরুদ্ধে। এই মামলায় মাইকেলকে গ্রেফতার করার কোনও কারণ ছিল না। ওকে প্রয়োজন হতে পারে সাক্ষী হিসেবে। সে পরে দেখা যাবে। অনেক বেশি জরুরি কাজ এখন পড়ে আছে হাতে।
প্রথম কাজ সুজয়ের ঘরের তল্লাশি। বাজেয়াপ্ত হল বেশ কিছু গর্ভনিরোধকের প্যাকেট, মদের বোতলও একাধিক, বিছানার চাদর। কাজ নম্বর দুই, অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী, দু’জনেরই ডাক্তারি পরীক্ষা, পরিভাষায় ‘মেডিক্যো-লিগাল একজামিনেশন’। ঘটনার সময় দু’জনে যা পোশাক পরেছিলেন, তা বাজেয়াপ্ত করা হল। পাঠানো হল ফরেনসিক পরীক্ষায়।
সুজয় আগাগোড়াই অভিযোগ অস্বীকার করলেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে। বলে গেলেন, ‘ইট ওয়াজ় কনসেনসুয়াল।’ যা হয়েছে, উভয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় উড়ে গেল আত্মপক্ষ সমর্থনে সুজয়ের এই দাবি। রিপোর্ট জানাল, জুডিথের শরীরে ‘ডিফেন্সিভ উন্ডস’ (আত্মরক্ষাজনিত আঘাত) রয়েছে। রয়েছে বলপূর্বক সহবাসের অকাট্য প্রমাণ। ‘কনসেনসুয়াল’ নয়, ‘রেপ’-ই। পোশাক-আশাকের ফরেনসিক পরীক্ষায়ও খারিজ হয়ে গেল সুজয়ের ‘সম্মতিমূলক শরীরী মিলন’-এর তত্ত্ব।
এই কেসের তদন্তের দায়িত্ব যে গোয়েন্দাবিভাগের উপর পড়বে, জানাই ছিল। ৬ জুন মামলার তদন্তভার নিল ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। গোয়েন্দাপ্রধান গঠন করলেন বিশেষ টিম। সাব-ইনস্পেকটর তৃষ্ণা বসু (বর্তমানে ইনস্পেকটর) নিযুক্ত হলেন তদন্তকারী অফিসার হিসেবে। তাঁকে সাহায্য করার জন্য রইলেন ইনস্পেকটর গৌরী মুখোপাধ্যায় (পদোন্নতি হয়ে বর্তমানে গোয়েন্দাবিভাগেই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার) এবং ইনস্পেকটর পৃথ্বীরাজ ভট্টাচার্য।
জুডিথ নিজেই ফের বয়ান দিতে চাইলেন তদন্তকারীদের কাছে। জানালেন, এফআইআর-এ যা লিখেছিলেন, সেটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল। তখনকার মানসিক অবস্থায় খুব বিস্তারিত লিখতে পারেননি। ক্লাইভ স্ট্রিটে আইরিশ দূতাবাসের অফিসে নেওয়া হল জুডিথের বিস্তারিত বয়ান, যাতে সেদিন সন্ধে থেকে কী কী, কীভাবে, কখন ঘটেছিল, তা আরও বিস্তারে জানালেন জুডিথ। এই বিবৃতি রেকর্ড করা হল জুডিথের মা এবং দাদার উপস্থিতিতে। যাঁরা ঘটনার কথা জানার পরের দিনই ডাবলিন থেকে ফ্লাইট ধরেছিলেন ভারতের। দিল্লির আইরিশ দূতাবাসের মূল অফিস থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন ফার্স্ট সেক্রেটারি ক্যাটি মরিসরো। তিনিও থাকলেন বয়ান নথিভুক্ত করার সময়। আদালতেও গোপন জবানবন্দি দিলেন জুডিথ, ফৌজদারি বিধির ১৬৪ ধারায়। এবং মা-দাদার সঙ্গে দেশের ফ্লাইট ধরলেন ১৩ জুন। বিচারের সময় আরেকবার আসতে হবে, যাওয়ার আগে জুডিথকে বললেন তৃষ্ণা। জুডিথ বললেন, ‘শিয়োর।’
আয়ারল্যান্ড দূতাবাস থেকে মামলার অগ্রগতি জানতে চেয়ে সপ্তাহে একটা করে চিঠি আসতে শুরু করল। স্বাভাবিক। নিজের দেশের কোনও নাগরিক ‘টুরিস্ট ভিসা’ বা ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ নিয়ে বিদেশ গিয়ে যৌননিগ্রহের শিকার হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটা অস্বস্তি তো মাথাচাড়া দেবেই। তদন্তকারীদের উপর চাপ বাড়তে শুরু করল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চার্জশিট দেওয়ার।
সেই চাপ সামলানো দুরূহ হল না তেমন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণ প্রমাণিত। দু’জনের সে-রাতের পোশাক-আশাকের ফরেনসিক পরীক্ষাতেও সমর্থন মিলেছে ডাক্তারের রিপোর্টের। পার্ক হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজেও ‘তন্ত্র’-য় সেদিনের পার্টিতে সুজয়ের উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে। পার্টির পর সুজয়-মাইকেলের সঙ্গে জুডিথের হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার একাধিক সাক্ষী রয়েছে। রয়েছে সুজয়-জুডিথের ফোনের টাওয়ার লোকেশন, যা খাপে খাপে মিলিয়ে দিচ্ছে সদর স্ট্রিটে মাইকেলের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়া থেকে ভোর সোয়া ছ’টা পর্যন্ত দু’জনের একত্রে অবস্থান। আছে আদালতে দেওয়া জুডিথের জবানবন্দি। পয়লা জুনের সকালে কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো পোশাকে ট্যাক্সি খুঁজছেন এক বিদেশিনী যুবতী, এই দৃশ্যেরও স্থানীয় সাক্ষী রয়েছে একাধিক।
কী বাকি থাকে আর? সাক্ষ্যপ্রমাণ একত্রিত করে তৃষ্ণা চার্জশিট পেশ করলেন ১১ জুলাই। ঘটনার ঠিক একচল্লিশ দিনের মাথায়। এবার নতুন টার্গেট, বিচারপর্ব দ্রুত শেষ করতে আদাজল খেয়ে লেগে থাকা। এই মামলায় শাস্তি হওয়াটাই যথেষ্ট নয় শুধু। হতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
কিন্তু টার্গেট স্থির করা এক, আর সেটা পূরণ করা আরেক। গোয়েন্দাবিভাগ প্রথম হোঁচটটা খেল খোদ জুডিথেরই কাছ থেকে। ভারত ছাড়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিচারপর্বে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসার। কেস এবার ‘ট্রায়াল স্টেজ’-এ, জুডিথকে মেল করে জানানো হল। প্রত্যুত্তরে জুডিথ জানালেন, বিচারপর্বে আসতে পারবেন না ভারতে। আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে অক্ষম। তৃষ্ণা ফের অনুরোধ করলেন জবাবি মেলে, অন্তত দিন পনেরোর জন্য এলেই যথেষ্ট। বিদেশে বেশিদিন থাকা যে অসুবিধের, সেটা বিচারক নিশ্চয়ই বিবেচনা করবেন, তাড়াতাড়িই মিটে যাবে সাক্ষ্যদান-পর্ব। কিন্তু জুডিথ অনড়। আর ইন্ডিয়ায় আসবেন না কিছুতেই। আয়ারল্যান্ডে ফোন করেও বিস্তর বোঝানোর চেষ্টা করলেন গৌরী-তৃষ্ণা। কিন্তু জুডিথের এক কথা, সশরীরে ওই সুজয় মিত্রের মুখোমুখি হওয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া ওই রাতের ঘটনা নিয়ে আদালতে প্রকাশ্য কাটাছেঁড়া সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তাঁর।