বাকিটা পড়ুন জুডিথের বয়ানে, যে বয়ান দিয়েছিলেন তদন্তকারী অফিসারদের।
‘আমার যতটা না রাগ হচ্ছিল, তার থেকে বেশি ভয় হচ্ছিল। তিনতলার ওই ফ্ল্যাটটায় একটা বারান্দা ছিল। একবার এ-ও ভেবেছিলাম, ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দিই নীচে। মাথা কাজ করছিল না। শুধু ভাবছিলাম, কেন রাজি হলাম মাইকেলের ফ্ল্যাটে যেতে গত রাতে? হোয়াই ডিড আই এগ্রি? কেন এভাবে ড্রাঙ্ক হয়ে গেলাম? কেন রাজি হলাম ওদের কথায়?
সুজয়কে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করলাম সর্বশক্তিতে,‘জাস্ট গেট লস্ট!’ একটু থতমত খেয়ে রাস্তা ছেড়ে দিল সুজয়। আর আমি দরজা খুলে দৌড়লাম নীচে। বড় একটা রাস্তা, পাশেই মেট্রো স্টেশন। নামটা পড়লাম। কালীঘাট। কালীঘাট? এই স্টেশনেই তো এসেছিলাম পার্ক স্ট্রিট মেট্রো থেকে, গডেস কালীর টেম্পল দেখতে!
সকাল হয়ে গিয়েছিল। সাড়ে ছ’টা বাজে প্রায়। গাড়িঘোড়ার চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। লোকজনও বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। কৌতূহল নিয়ে দেখছে আমাকে। অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। একটা ট্যাক্সি থামালাম। উঠে ঠিকানা বললাম হোটেলের। গাড়ি যখন চলছে, ফোন করলাম মনিকাকে। তুলল না। উইলিয়ামসকে করলাম, আফরোজকে করলাম। নো রেসপন্স। লেট নাইটের পরে ন্যাচারালি ঘুমচ্ছে নিশ্চয়ই সবাই। তিনজনকেই এসএমএস করলাম, ‘প্লিজ় রেসপন্ড, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার।’
সেই এসএমএস প্রথম দেখলেন মনিকা। ধড়মড়িয়ে উঠে ফোন করলেন জুডিথকে। ঘটনা জানার পর মনিকা-আফরোজ-উইলিয়ামস যখন পৌঁছলেন ‘হোটেল সার্কুলার’-এ, সকাল তখন প্রায় সাড়ে দশটা। নিজের ঘরে বসে কেঁদে চলেছেন জুডিথ। যাঁকে কিছুটা ধাতস্থ করতেই লাগল ঘণ্টাদেড়েক। জুডিথকে নিয়ে বন্ধুরা পার্ক স্ট্রিট থানায় পৌঁছলেন সোয়া বারোটা নাগাদ। ওসি শুনলেন সব, ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে সময় নিলেন না একটুও। জুডিথদের নিয়ে নিজেই গেলেন কালীঘাট থানায়। জমা পড়ল সুজয় মিত্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ।
সুজয়ের বাড়ির যেটুকু বর্ণনা জুডিথ দিতে পারলেন, পুলিশের পক্ষে সেটা যথেষ্ট ছিল বাড়িটা দ্রুত চিহ্নিত করতে। কালীঘাট মেট্রো স্টেশন, বড় রাস্তা, তিনতলা বাড়ি। ১৩৮, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের বাড়িটাকে শনাক্ত করলেন জুডিথ। হ্যাঁ, এটাই। তিনতলার ঘরে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় শুয়ে থাকা সুজয়ের নাগাল পাওয়া গেল সহজেই। ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে এই ঘরে। দরকার হবে খুঁটিয়ে তল্লাশির। ঘরটা ‘সিল’ করে দিয়ে দুপুর দুটো নাগাদ যখন সুজয়কে নামিয়ে এনে ভ্যানে তুলছে কালীঘাট থানার পুলিশ, তখন ভিড় জমে গেছে বাড়ির সামনে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। জয়েন্ট সিপি (ক্রাইম) সহ পদস্থ অফিসাররা রওনা দিয়েছেন কালীঘাট থানার উদ্দেশে।
টিভি-র পরদায় ‘ব্রেকিং নিউজ়’ চলতে শুরু করল ঘণ্টাখানেক পর থেকেই। একের পর এক ওবি ভ্যান এসে ভিড় জমাল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের সেই বাড়ির সামনে, ‘এই সেই বাড়ি, যেখানে গতরাতে ধর্ষিতা হয়েছেন এক আইরিশ যুবতী। গ্রেফতার হয়েছেন অভিযুক্ত। নাম সুজয় মিত্র।’
অল্প কথায় এবার সুজয়ের পরিবার-পরিচয়। দক্ষিণ কলকাতার বনেদি বিত্তশালী পরিবার সুজয়দের। ইলেকট্রনিক গুডসের পুরনো এবং রমরমা পারিবারিক ব্যবসা। সুজয়ের বাবাই দেখাশোনা করেন ব্যবসার। দুই ছেলে। সুজয় বড়, বয়স ছত্রিশ। ছোটভাইও তিরিশের কোঠায়। কনভেন্ট-শিক্ষিত সুজয় গ্র্যাজুয়েশনের পর এমবিএ করেছিলেন। আমেরিকাতে গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানেই এক মার্কিন সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম এবং বিয়ে। সস্ত্রীক দেশে ফিরেছিলেন, কিন্তু বিয়েটা টেকেনি বেশিদিন। স্ত্রী ফিরে গিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। সরকারি ভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি, কিন্তু দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ বা সম্পর্ক, কোনওটাই বেঁচে নেই আর। কাজ বলতে কালেভদ্রে নাম-কা-ওয়াস্তে বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করা। আসল ‘কাজ’ অবশ্য পার্টি-মদ-মহিলা-ড্রাগে বুঁদ হয়ে থাকা।
তিনতলা বাড়ির একতলাটা ব্যবহৃত হয় ব্যবসার কাজে। দু’তলাটা ভাড়া দেওয়া আছে। মিত্র পরিবারের সদস্যরা থাকেন তিনতলায়। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে যথেষ্ট প্রশস্ত, অন্তত দুই হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটা। চারটে ঘরের একটায় সুজয়ের মা-বাবা থাকেন। একটা মোটামুটি খালিই পড়ে থাকে। বাড়িতে গেস্ট এলে ব্যবহার হয়। বাকি দুটো ঘরে দুই ভাই। ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে সবার কাছেই। সুজয় যখন সেই রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে নিজের ঘরে জুডিথকে নিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বাড়ির অন্যরা তখন গভীর ঘুমে। সকাল সোয়া ছ’টা নাগাদ যখন জুডিথ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুম ভেঙেছিল সুজয়ের মা-বাবা-ভাইয়ের। পুলিশ যখন দুপুরবেলা তালাবন্ধ করে দিচ্ছে বড়ছেলের ঘর, নীচে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মা-বাবা। ওসি-কে শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সুজয়ের মা, ‘কী করেছে ও?’
জুডিথের কাছে ঘটনার বিবরণ শোনার পরেই থানার একটা টিম বেরিয়ে গিয়েছিল মাইকেলের খোঁজে। সদর স্ট্রিটে স্থানীয় ‘পেয়িং-গেস্ট অ্যাকোমোডেশন’গুলোয় মাইকেলের চেহারার বিবরণ দিয়ে একটু খোঁজখবর করতেই হদিশ মিলেছিল মাইকেলের দু’কামরার ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটের। ভাড়ার ফ্ল্যাট। তালাবন্ধ। তালা ভেঙে কয়েকটা খালি ওয়াইনের বোতল আর সামান্য পোশাক-আশাক ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি।