কলকাতায় এসে জুডিথরা ঠিক করলেন, ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র কাছাকাছি হোটেলে থাকাই ভাল। সুবিধে হবে যাতায়াতের। জুডিথ উঠলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ‘হোটেল সার্কুলার’-এ। মনিকা, উইলিয়ামস আর বাকিরাও কাছেপিঠের হোটেল বা গেস্টহাউসে।
সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরেই দৌড়নো ‘মাদার হাউসে’। সিস্টারদের কাছে ইন্ডোর ট্রেনিং নেওয়া, হাতে-কলমে কাজ শেখা দিনভর, ওয়ার্কশপ-ফিল্ড ট্রেনিং সেরে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে। ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র সঙ্গে অবৈতনিকভাবে যুক্ত একাধিক ডাক্তারের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল দিব্যি।
কলকাতা শহরটাকে অল্পদিনেই ভাল লাগতে শুরু করল জুডিথের। ট্রেনিং শিডিউল অনুযায়ী শনিবার বিকেল থেকে ছুটি। ফের কাজ শুরু সোমবার থেকে। উইকেন্ডে বন্ধুদের সঙ্গে শহরটা অনেকটাই ঘুরে দেখেছে জুডিথ। ভিক্টোরিয়া, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, টেম্পল অফ গডেস কালী, নোবেল লরিয়েট পোয়েট টেগোরের বাড়ি…। ক্যালকাটার মানুষজনকে খুব হেল্পফুল লেগেছে জুডিথের। কোথায় কোন্দিক দিয়ে যেতে হবে, সেটা পথচলতি কাউকে জিজ্ঞেস করলে কারও কোনও বিরক্তি নেই। হাসিমুখে বলে দেয়। লাইফ আছে শহরটায়। ঘুরে-টুরে অবশ্য জুডিথের সবথেকে ভাল লেগেছে সন্ধে-রাতের পার্ক স্ট্রিট। আলো ঝলমল রাস্তাটা যেন ফুটছে সবসময়। আর দিনকয়েক পরেই তার জন্মদিন। দেশের বাইরে জন্মদিন কাটানো এই প্রথম। এই পার্ক স্ট্রিটের কোনও রেস্তোরাঁ বা পাবে একটা ছোটখাটো বার্থডে পার্টি করলে কেমন হয়?
৩১ মে, ২০১৩। বার্থডে পার্টি, জুডিথের একুশতম জন্মদিন। পার্ক হোটেলের নাইটক্লাব ‘তন্ত্র’ নাকি বেশ জমজমাট জায়গা উইকেন্ড পার্টির জন্য, শুনেছিলেন কলকাতায় সদ্যপরিচিতদের মুখে। যে হোটেলে আছেন, তার ম্যানেজারকেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনিও কাছেপিঠের মধ্যে তন্ত্র-র কথাই বলেছিলেন। বেশ, ওখানেই হোক। রাত দশটা থেকে দুটো অবধি তন্ত্র-তে জায়গা বুক করেছিলেন জুডিথ। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা তো বেশি নয়,এই অজানা শহরে চেনেনই বা ক’জনকে? আয়ারল্যান্ড থেকে আসা গ্ৰুপের মধ্যে দশজন। আর ‘মাদার হাউসে’ আলাপ হওয়া ডাক্তার বন্ধু আফরোজ আলম। সব মিলিয়ে জনা বারো।
সকালে কেক কিনে এনেছিল মনিকা। মজা-হইহল্লা বিস্তর হয়েছে হোটেলের ঘরেই। স্কাইপে কথাও হয়েছে মা-বাবা-দাদার সঙ্গে। ফুরফুরে মেজাজে সেজেগুজে রাতের পার্টির জন্য উইলিয়ামসের সঙ্গে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরিয়েছিলেন জুডিথ। লিন্ডসে স্ট্রিটের মোড়ে এসে যখন ট্যাক্সি খুঁজছেন, ট্র্যাফিক সিগন্যালের লালে থেমে আছে গাড়ি, পাশের একটা গাড়ি থেকে ছিটকে আসা আওয়াজে ফিরে তাকিয়েছিলেন জুডিথ।
‘হাই উইলিয়ামস! হোয়াটস আপ?’
মিনিটখানেকের মধ্যেই জানা হয়ে গিয়েছিল, ওই গাড়ির চালকের নাম অভিষেক ওরফে অ্যাবি। উইলিয়ামসের সঙ্গে যার খুচরো আলাপ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে, নিউ মার্কেটের একটা জুতোর দোকানে। এবং আদানপ্রদান হয়েছে ফোন নম্বরের। অ্যাবি স্বাভাবিক সৌজন্যে জানতে চেয়েছিল, কোথায় যাচ্ছে উইলিয়ামসরা।
‘তন্ত্ৰা? বার্থডে ব্যাশ? হপ ইন গাইজ়! আইল গিভ ইউ আ রাইড।’
উইলিয়ামসের পরিচিত, যাওয়ার পথে ড্রপ করে দিতে চাইছে পার্ক হোটেলে। গাড়ির পিছনের সিটে নির্দ্বিধায় উঠে পড়েছিলেন দু’জনে। সামনে স্টিয়ারিংয়ে ছিল অ্যাবি। পাশে আরেকজন। সপ্রতিভ, দেখে মনে হয়, মিড-থার্টিজ়। পিছনে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, ‘হাই, দিস ইজ় সুজয়। সুজয় মিত্র।’
লিন্ডসে স্ট্রিট থেকে কতটাই বা দূরে আর পার্ক হোটেল? খুচরো আলাপের মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটে। স্বাভাবিক সৌজন্যবশত জুডিথ বলেছিলেন নামার সময়, ‘হোয়াই ডোন্ট ইউ গাইজ় জয়েন আস?’ বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল সুজয় আর অ্যাবি। কে জানত তখন, ওই সৌজন্য-প্রস্তাবের জন্য আজীবন আফশোস করতে হবে?
‘তন্ত্র’ জায়গাটা সত্যিই জমজমাট। যাকে বলে হ্যাপেনিং। ইউরোপের যে-কোনও নাইটক্লাবের মতোই। পছন্দ হয়েছিল জুডিথের। ডিজে একের পর এক চার্টবাস্টার গান বাজাচ্ছে উদ্দাম। পা নড়তে বাধ্য তালে তালে। সুজয় ছেলেটাও মজার। ভাল লেগেছিল জুডিথের। এমন সহজভাবে মিশে যাচ্ছিল সবার সঙ্গে, কে বলবে অপরিচিত, কে বলবে অন্য ইনভাইটিজ়দের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সবেমাত্র? দুর্দান্ত সেন্স অফ হিউমার, জোকসের স্টক অফুরান। আর ইংরেজিটা বলে তুখোড়, নিখুঁত ইউরোপিয়ান অ্যাকসেন্টে। ইন্ডিয়ার বাইরে ছিল কখনও?
অ্যাবি বেশিক্ষণ ছিল না পার্টিতে। আধঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সুজয় থেকে গিয়েছিল। আর সুজয়ই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মাইকেলের সঙ্গে। যে হঠাৎই এসে যোগ দিয়েছিল ওদের গ্ৰুপটার সঙ্গে। যার হাবভাব দেখেই মনে হয়, নিয়মিত যাতায়াত আছে এখানে। পেটানো চেহারা, লম্বায় অন্তত ছ’ফুট প্লাস, কায়দার পনিটেল। ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস’ বলার পরেই মাইকেল সিগারেট ধরাল একটা। ধরাল নয়, বানাল। সিগারেটের মধ্যে অন্য কিছু ঠুসে যেটা সুজয়-মাইকেলের হাতে হাতে ঘুরতে থাকল মধ্যরাতের মাতোয়ারায়, তিন গ্লাস ওয়াইন খাওয়ার পরেও দিব্যি বুঝতে পারছিলেন জুডিথ, ওগুলো সিগারেট নয়। জয়েন্ট। ড্রাগ জায়গা বদল করে নিয়েছে তামাকের সঙ্গে। সে ওরা যা করছে করুক, ভেবেছিলেন জুডিথ। মাথাটা হালকা লাগছে, বেশি ভেবে লাভ নেই। তাই সুজয় যখন এসে বলেছিল, ‘হেই.. হোয়াট অ্যাবাউট আ ডান্স?’, বিনা দ্বিধায় ডান্স ফ্লোরে পা রেখেছিলেন জুডিথ। ডিজে-র ডিস্কে তখন বাজছিল, ‘দ্য নাইট ইজ় স্টিল ইয়াং…’। খুব পছন্দের গান জুডিথের। নাচছিলেন প্রাণ খুলে। জানতেন না, রাত আজ সত্যিই বাকি। এবং অনেকটাই।