‘ফিলিং স্লিপি বেবি?’ বলে সুজয় যখন বিছানায় উঠে এসেছিল, হাত রেখেছিল গালে, ওই আধোজাগা অবস্থাতেও জুডিথ বুঝেছিলেন সহজাত নারী-ইন্দ্রিয়ে, এ স্পর্শ নিছক বন্ধুত্বের নয়। উঠে বসতে চেয়েছিলেন। পারেননি। শিরা-ধমনিতে অ্যালকোহলের দাপাদাপিতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। এবং সুজয় যখন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছিল গায়ের জোরে, আপ্রাণ প্রতিরোধও কাজে আসেনি। ‘নো! প্লিজ় নো… প্লিজ়…’, নিষ্ফল চিৎকারে এটুকু বলতে পেরেছিলেন শুধু, মনে আছে।
ওটুকুই। বাকিটা ব্ল্যাকআউট। ‘ফরম্যাটিং’ করে কেউ যেন পরিপাটি মুছে দিয়েছে মেমরি কার্ড থেকে।
.
চ্যানেলে চ্যানেলে ‘ব্রেকিং নিউজ়’ চলতে শুরু করল দুপুর আড়াইটে-পৌনে তিনটে থেকে। যে খবর নেহাতই মামুলি এবং সবার জানা হয়ে গেছে, তাতে হরেক মালমশলা মিশিয়ে ‘ব্রেকিং’ বলে চালিয়ে দেওয়ার যে ফর্মুলা চালু আছে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে, তার অনুসারী নয় এ ঘটনা। উদ্বেগ-আশঙ্কা-চাঞ্চল্য-ঔৎসুক্য… যাবতীয় উপাদান মজুত এই খবরে। আক্ষরিক অর্থেই ‘ব্রেকিং’।
‘দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে বিদেশিনীকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত গ্রেফতার’…, ‘ভোররাতে শারীরিক অত্যাচারের শিকার বিদেশিনী যুবতী, পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্ত’…, ‘শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে লালবাজার, রিপোর্ট তলব স্বরাষ্ট্র দফতরের’…।
অত্যাচারিতা যেহেতু বিদেশিনী, স্থানীয় সীমানা ছাড়িয়ে দ্রুত সর্বভারতীয় মিডিয়ায় নিজস্ব নিয়মে জায়গা করে নিল খবরটা। জাতীয় স্তরের চ্যানেলগুলোতেও সমান গুরুত্ব দিয়ে শুরু হল ঘটনার বিবরণ।
ঘটনার বিস্তারে ঢোকার আগে সামান্য দু’-চার কথা। গোয়েন্দা কাহিনিতে আসক্ত পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে, ‘রহস্যহীনতায় কে বাঁচিতে চায়!’ যে মামলার কথা লিখছি, গোড়াতেই স্বীকার্য, তা সেই অর্থে রহস্যহীনই। অপরাধী যে আসলে কে, একাধিক সূত্রের খোলস ছাড়িয়ে সেটা আন্দাজ করার রোমাঞ্চ নিরুদ্দেশ এই কেসে। বরং উলটোটাই। অভিযুক্ত চিহ্নিত অপরাধের ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই। এবং গ্রেফতারও অনতিবিলম্বে। তা হলে আর রহস্যের রইলটা কী?
লেখার এখানে এটুকুই, গুরুতর মামলার তদন্ত মোটেই সীমায়িত নয় স্রেফ অপরাধীর চিহ্নিতকরণে। শাস্তিবিধান নিশ্চিত করাতেই তার পূর্ণতা। বাস্তবের তদন্ত ছোটগল্প নয়, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’-এর অমোঘ মোচড় কেস ডায়েরিতে অধরা। তদন্ত তুলনীয় নয় উপন্যাসের সঙ্গেও, চরিত্রের চালচিত্র বা ঘটনার ঘনঘটায় যা আমূল নাড়িয়ে দেবে পাঠককে। কোনও কেসের সমাধান-পরবর্তী তদন্ত আপাত-নীরস প্রবন্ধের মতো। যার অনাড়ম্বর গতিপথে আসলে লুকিয়ে থাকে বহু চড়াই-উতরাই। আলোচ্য মামলাটি যেমন। তদন্তকারীদের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের নিরিখে শুধু কলকাতা নয়, দেশের তদন্ত-ইতিহাসেও এই কেস দিক্চিহ্নস্বরূপ।
কালীঘাট থানার মামলা। তারিখ, পয়লা জুন ২০১৩। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬(১) ধারায়। অভিযোগ ধর্ষণের। অভিযোগকারিণী বিদেশিনী। আইরিশ যুবতী। নাম জুডিথ।
জুডিথ ফ্লোরেন্স। আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি কাভানের কাছে বাল্টিমোরস ব্রিজ বলে এক মফস্সল শহরের বাসিন্দা। মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজছাত্রী। বয়স কুড়ি ছাড়িয়ে একুশ ছোঁয়ার মুখে। আর পাঁচটা ওই বয়সের তরুণী যেমন হন, তেমনই। উচ্ছল, প্রাণবন্ত। হাসিখুশি আমুদে স্বভাবের জন্য বন্ধুবৃত্তে তুমুল জনপ্রিয়। সপ্তাহান্তে বন্ধুদের ‘গেট টুগেদার’-এর হইহুল্লোড় জমেই না জুডিথকে ছাড়া।
কলেজের পড়াশুনো আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি সমাজসেবাতেও কিশোরীবেলা থেকেই ঝোঁক জুডিথের। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন সময়-সুযোগ হলেই। মাদার টেরিজার কথা শুনে এসেছেন ছোটবেলা থেকে। প্রবল ইচ্ছে, মাদারের ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত হওয়ার। সেটার মূল কর্মকাণ্ড অবশ্য ইন্ডিয়ায়, ক্যালকাটা বলে একটা শহরে। ওয়েস্টবেঙ্গল বলে স্টেটে। হলই বা বহুদূরের বিদেশবিভুঁই, যাওয়া যায় না একবার?
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়ই। হলও। ডাবলিনের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ কলকাতার ‘মাদার হাউস’-এর। যে সংস্থা প্রতি বছরই ইউরোপের একাধিক শহর থেকে বাছাই করা জনা বিশেক তরুণ-তরুণীকে নিয়ে যায় কলকাতায়, হাতেকলমে ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। জুডিথ গিয়ে ধরলেন এই এনজিও-র কর্তাদের। ইন্টারভিউ হল একটা, যাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে জুডিথের সামান্যতম সংশয়ও ছিল না। নির্বাচিতদের প্রশিক্ষণ পর্ব চলল আয়ারল্যান্ডেই, সপ্তাহদুয়েক ধরে। জনা কুড়ির গ্রুপ। সমবয়সি প্রায় সবাই। অধিকাংশের সঙ্গে অল্পদিনেই গলায়-গলায় বন্ধুত্ব হয়ে গেল জুডিথের। চনমনে যুবক উইলিয়ামস আর ফিটনেস-ফ্যানাটিক মনিকার সঙ্গে তো প্রায় ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’-এর রসায়ন!
দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়ে গেল ভারত-যাত্রার। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যাওয়া, জুলাইয়ের মাঝামাঝি ফেরা। ওই সময়টা সচরাচর ভ্যাকেশন থাকে বেশিরভাগ কলেজে। ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সুবিধে। ডাবলিন বিমানবন্দরে যখন চেক-ইন করছেন ভারতগামী উড়ানে পা রাখার জন্য, জুডিথ দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, এটাই ইন্ডিয়ায় প্রথম এবং শেষবারের মতো যাওয়া। আয়ারল্যান্ডের ফিরতি উড়ান ধরতে হবে মাসখানেকের মধ্যেই।