দু’দিনের মধ্যে দুষ্কৃতীদের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে আধডজন খুন হলে পুলিশি প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়ার, তেমনই হল। জেলার সমস্ত থানা থেকে অফিসার-ফোর্স এনে শ্যামল আর বাঘা, দু’জনের গ্ৰুপের ছেলেদের সবার বাড়িতে রাতভর তল্লাশি-অভিযান। সোর্সের খবর অনুযায়ী একাধিক গোপন ঠেকে একযোগে হানা। মোড়ে মোড়ে পুলিশ পিকেট। গাড়ি থামিয়ে নাকা-চেকিং। চব্বিশ ঘণ্টাই সাদা পোশাকে নজরদারি তিন শিফটে। ধরাও পড়ল বেশ কয়েকজন। কিন্তু মূলত যাকে ধরার জন্য এত আয়োজন, সেই শ্যামল বেপাত্তা। ভ্যানিশ।
শ্যামলের ঘনিষ্ঠ বলয়ে ছিল যারা, সেই রমেশ-বাপি-মন্টু-পুতন-নেপু-চিকুয়া-রা সবাই কখনও না কখনও ধরা পড়েছিল নয়ের দশকের এই শেষের বছরগুলোয়। শ্যামলই শুধু ‘অড ম্যান আউট’। ধরা পড়েনি কখনও। কোনও গুন্ডা-মস্তান কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় কিছুদিন দাদাগিরি করে বেড়িয়েছে, মস্তানিতে কাঁপিয়ে দিয়েছে, এমন উদাহরণ খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু শ্যামলের ব্যাপারটা আলাদা। এত খুন-জখম-লুঠপাট করেও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বছরের পর বছর অধরা থাকাটা শ্যামলকে শুধু হুগলিতে নয়, সারা রাজ্যেরই অপরাধ-মানচিত্রে ‘মিথ’-এর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর যে ধরা পড়ে পড়ুক, শ্যামলকে ধরতে পারবে না পুলিশ, এই ধারণাটা একটা দীর্ঘসময় ধরে জলবাতাস পেয়েছিল। শ্যামল নিজেও ‘ডন’ ছবিতে বচ্চনের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া ডায়লগটা সামান্য পালটে নিয়ে বলত রাতের আড্ডায়, ‘শ্যামলকো পকড়না মুশকিল হি নহি… না-মুমকিন হ্যায়।’
কেন মুশকিল? কেন না-মুমকিন? কোন জাদুমন্ত্রে নিজের রাজ্যপাট দিব্যি কায়েম রেখেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকত পুলিশের? পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মী-অফিসার, যাঁরা নব্বই-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে পরের দশ বছরের কোনও না কোনও সময় কাজ করেছেন শ্রীরামপুর মহকুমায় বা হুগলি জেলার অন্যত্র, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে একাধিক কারণ বেরিয়ে আসে।
এক, শ্যামলের অত্যাশ্চর্য ইনফর্মার-নেটওয়ার্ক। যাঁরা রিষড়া-কোন্নগর অঞ্চলের বাসিন্দা বা নিয়মিত যাতায়াত আছে ওই এলাকায়, তাঁরা জানবেন স্থানীয় ভূগোল। যাঁরা যাননি কখনও, ধারণা নেই তেমন, তাঁদের জন্য বলা, রিষড়া-কোন্নগর অঞ্চলের বিভিন্ন বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরির বিস্তীর্ণ এলাকার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল শ্যামলের বিচরণভূমি। অ্যালকালি… জেকে স্টিল… বিন্দাল… ইউনাইটেড ভেজিটেবলস…। পাশাপাশি ছিল স্থানীয় ক্লাব ‘সেবক সংঘ’-র মাঠ.. ধর্মডাঙা… বারুজীবী কলোনি…।
শেষ যে জায়গার নামটা লিখলাম, কৌশলগত কারণে সেটাই ছিল শ্যামলের পক্ষে নিরাপদতম। বারুজীবী কলোনি। রাতে এখানেই থাকত বেশিরভাগ সময়। কেন? এই জায়গাটায় তিনদিক দিয়ে ঢোকা যেত। রিষড়া রেলগেট দিয়ে। কোন্নগর আন্ডারপাস দিয়ে। কিংবা দিল্লি রোড দিয়ে ডানকুনি হয়ে। ডানকুনি হয়ে পুলিশের গাড়ি ঢুকলে দেখা যেত অনেক দূর থেকে। কিন্তু রিষড়া রেলগেট বা কোন্নগর আন্ডারপাস দিয়ে পুলিশের পক্ষে দ্রুত ঢুকে যাওয়া সম্ভব ছিল বারুজীবী কলোনিতে। ডিফেন্সকে মজবুত করতে তাই রেলগেট আর আন্ডারপাসের মুখে সন্ধে থেকে ভোর অবধি ‘ডিউটি’ করত শ্যামলের বাহিনী। নজরে রাখত প্রতিটা গাড়ি, প্রতিটা বাইককে। সাদা পোশাকে পুলিশ ঢুকছে, এ নিয়ে সামান্যতম সন্দেহ হলেও নিমেষের মধ্যে মোবাইলে খবর চলে যেত শ্যামলের কাছে।
এ তো গেল রাত। নজরদারি বজায় থাকত দিনের বেলায়ও। এলাকার প্রতিটা গলিতে, প্রতিটা মোড়ে ছড়িয়ে থাকত ইনফর্মাররা। যাদের সবাইকে মাসে মাসে ভদ্রস্থ অঙ্কের টাকা দিত শ্যামল। দিয়ে রাখত মোবাইল ফোন। ওসি থেকে শুরু করে এসডিপিও বা জেলার এসপি স্বয়ং…বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অফিসার কম চেষ্টা তো করেননি শ্যামলকে ধরতে। রিকশা করে, অটো করে, বাইকে করে, নানারকম ছদ্মবেশে প্রাণপ্রাত চেষ্টা হয়েছে, যাতে পুলিশের গতিবিধি আন্দাজ করতে না পারে শ্যামলের লোকেরা। কিন্তু লাভ হয়নি। ‘খবর’ হয়ে গেছে মোক্ষম সময়ে। পাখি উড়ে গেছে।
শ্যামল যে সময়ে ক্রমে ত্রাস হয়ে উঠছে রিষড়া-কোন্নগর-উত্তরপাড়া এলাকায়, তখন ওই এলাকায় কাজ করেছেন এমন এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য তুলে দিচ্ছি হুবহু, …‘ডিমওয়ালা, সবজিওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, ইস্ত্রিওয়ালা, পাড়ার চায়ের দোকান, মুদির দোকান, সর্বত্র সোর্স ছিল শ্যামলের। এটা রেইড-এর সময় আমরা ফিল করতে পারতাম। ধরুন রিষড়া রেলগেট পেরলাম সিভিল ড্রেসে। রিকশা করে। বা পায়ে হেঁটে। অদৃশ্য নজরদারি যে একটা চলছে, সেটা সেন্স করতে পারতাম স্থানীয় মানুষের চোখের ইশারায় বা ফিসফিসানিতে। শ্যামলের চ্যালাচামুন্ডাদের মুখে শুনেছি, নানারকম কোডনেম ছিল খবর দেওয়ার। ‘‘ছোটপাখি’’ মানে ওসি। ‘‘মেজোপাখি’’ মানে সিআই বা সার্কেল ইনস্পেকটর। আর ‘‘বড়পাখি’’ মানে এসডিপিও। রেইড হত, কিন্তু ফিরতাম খালি হাতে। এক একসময় এত হতাশ লাগত যে কী বলব! মনে হত এলাকার গাছগুলোও বোধহয় শ্যামলের সোর্স। না হলে এতটা সিক্রেসি মেইনটেইন করার পরেও প্রত্যেকবার খবর পেয়ে যায় কী করে?’
এই ‘কী-করে’-র উত্তরেই উঠে আসে দ্বিতীয় কারণ। সোর্সের মধ্যেই ভূত। পুলিশেরই একাংশ মনে করেন, ফোর্সের মধ্যেও বিভিন্ন স্তরে নিজের লোক ‘ফিট’ করেছিল শ্যামল। অন্তর্ঘাত না হলে বারবার ‘অপারেশন’ ফেল করতে পারে না। আর রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কথা তো আগে লিখেইছি। বড়সড় কোনও ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়ার পর ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের অভাব হত না শ্যামলের। কখনও কখনও আবার পুলিশের ‘রেডার’-এর সম্পূর্ণ বাইরে চলে যেত দু’-একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীকে নিয়ে। মণিপুর, মেঘালয় বা মিজোরাম। এলাকা ঠান্ডা হলে ফিরে আসত কয়েক মাস পরে।