সুদীপা রাজি হল। রাজসাক্ষী হিসেবে বয়ান দিল আদালতে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার প্রয়োগে সুদীপাকে ক্ষমা করলেন বিচারক। আইনি পরিভাষায় যাকে বলে ‘Tender of pardon’। এই মামলায় সুদীপা আর অভিযুক্ত থাকল না আইন অনুযায়ী। ক্ষমাপ্রাপ্তির পর স্রেফ সাক্ষী। শুধু সাক্ষী নয়, রাজসাক্ষী।
তদন্তকারী অফিসার দুলাল সোম ৯১-এর ২০ ডিসেম্বর পেশ করেছিলেন চার্জশিট। যে চার্জশিটের মূল ভিত্তিভূমিই ছিল রাজসাক্ষী সুদীপার স্বীকারোক্তি। যে বয়ানের সমর্থনে সংগৃহীত হয়েছিল প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ।
ফুলবাগানের যে দোকান থেকে গিনিপিগ কিনেছিলেন রণধীর-কৃষ্ণেন্দু, তার মালিক আদালতে চিহ্নিত করেছিলেন দুই অভিযুক্তকে। কে সি দাশ-এর দোকানের এক কর্মচারীও মনে করতে পেরেছিলেন এক দোহারা চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোককে, যাঁর সারা মুখে শ্বেতির দাগ। এক কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে এসে যিনি কালোজাম আর সীতাভোগ কিনেছিলেন মার্চের এক দুপুরে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য আরও ছিল। সুদীপার স্কুলের অ্যাটেনডেন্স শিট, রণধীরের স্কুলের হাজিরা-খাতা। পাশাপাশি রাখলেই বোঝা যাচ্ছিল, একই দিনে ‘অ্যাবসেন্ট’ হতেন দু’জন। অলকা যে পালবাড়িতে অশান্তি করেছিলেন দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে, একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তার।
রণধীরের বাড়ি থেকে তামার তারও পাওয়া গিয়েছিল কয়েক গোছা, যা মৃতদেহগুলির সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখা তারের গঠনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল হুবহু। সুদীপা বাড়ির যে সব গয়না চুরি করে দিত স্যারকে, সেগুলো স্থানীয় এক দোকানে বন্ধক রেখে টাকা নিতেন রণধীর। চিহ্নিত হয়েছিল সেই দোকান। উদ্ধার হয়েছিল গয়না। সাক্ষ্য দিয়েছিলেন দোকানি।
প্রায় পাঁচ বছরের বিচারপর্ব শেষে জেলা আদালত রায় দিয়েছিল ৯৬-এর ৯ অগস্ট। রণধীর-কৃষ্ণেন্দুকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারক। রাজসাক্ষীদের ক্ষেত্রে যা প্রথা, বিচারপর্ব শেষে সুদীপা মুক্তি পেয়েছিল জেলজীবন থেকে। রণধীর-কৃষ্ণেন্দু হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। যেখানে বহাল থেকেছিল ফাঁসির হুকুম। সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন দুই সাজাপ্রাপ্ত। সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল-জবাব চলেছিল প্রায় দেড় বছর। ফাঁসির সাজা শেষ পর্যন্ত কমে দাঁড়িয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাসে।
একদিকে রণধীর-কৃষ্ণেন্দুর দোষী সাব্যস্ত হওয়া, অন্যদিকে রাজসাক্ষী সুদীপার মুক্তি, কম বিতর্ক হয়নি সে সময় এ নিয়ে। এটা কেমন বিচার হল? মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে চক্রান্ত করে একটা সতেরো বছরের মেয়ে ঠান্ডা মাথায় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলল মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাকে, তারপর দোষ স্বীকার করে নিল বলে চার খুন মাফ? যত দোষ শুধু রণধীর-কৃষ্ণেন্দুর? এবার থেকে তা হলে ষড়যন্ত্র করে মানুষ খুনেও বাধা নেই, দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেই যখন ক্ষমা করে দেবে আদালত?
সুদীপার মুক্তিপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ারও চেষ্টা হয়েছিল তখন, বিক্ষিপ্ত কিছু বিক্ষোভ-আন্দোলনে। কিন্তু আইন আইনই। আদালতও আদালতই। তার রায়ের উপর কথা চলে না। বিচারক সবদিক বিবেচনা করে মনে করেছিলেন, ক্ষমা প্রাপ্য সুদীপার। ক্ষমা করেছিলেন ফৌজদারি বিধির আইনসিদ্ধ প্রক্রিয়া অনুসারেই। সে সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বা যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত। অসংগতও।
.
রণধীর বসু। এক প্রৌঢ় শিক্ষক। যিনি অর্থকষ্ট থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতে চেয়েছিলেন মোহগ্রস্ত কিশোরী ছাত্রীর মাধ্যমে। লোকলজ্জাকে বন্ধক রেখেই। চারজন নিরপরাধ মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন ঠান্ডা মাথায়।
সপ্তদশী সুদীপা পাল। মায়ের শাসনে যার ক্ষোভ জমতে জমতে পরিণত হয়েছিল ক্রোধে-আক্রোশে-জিঘাংসায়। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল অসমবয়সি প্রেমে। জড়িয়ে পড়েছিল মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাকে খুনের চক্রান্তে।
কুড়ি বছরেরও বেশি কারাবাসের পর ২০১২ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন রণধীর। লালবাগ সংশোধনাগারে যখন ছিলেন, বন্দিদের অঙ্ক শিখিয়ে সময় কাটাতেন। জেলেই খুলেছিলেন কোচিং ক্লাস।
সুদীপা? ’৯১-৯৬, পাঁচ বছর জেলে থাকাকালীন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এক বন্দির সঙ্গে। কারাবাসেই ভেঙে গিয়েছিল সে সম্পর্ক। জেল থেকে মুক্তির পর যে জীবন বাইশ বছরের সুদীপার অপেক্ষায় ছিল, তা সুখের হয়নি। রণধীর কৃতকর্মের ফল জেলের ভিতরে ভোগ করেছিলেন। সুদীপা বাইরে। দারিদ্র্য-অসম্মান-লাঞ্ছনা-গঞ্জনার যে ধারাবাহিক ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে সুদীপাকে যেতে হয়েছিল, যেতে হচ্ছে এখনও, তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। কোথায় আছেন এখন, কীভাবে আছেন, সে বৃত্তান্তও না হয় থাক।
যা গেছে তা যাক।
৬. মিতিনমাসিও সত্যি
—উড ইউ কেয়ার ফর অ্যানাদার ড্রিঙ্ক?
মাথা নাড়লেন জুডিথ। ওয়াইন এমনিতে তাঁর বরাবরের পছন্দের। কিন্তু আজ আর ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। আচ্ছন্ন লাগছে। ঝিম ধরছে। অনেকটা খাওয়া হয়ে গেছে আজ। এতটা না খেলেই হত বোধহয়। কিন্তু একটু বেনিয়ম হয়ে তো যায়ই এক একটা বিশেষ দিনে। কী আর করা? শরীরের প্রতিটা কোষ একটাই দাবি করছে এখন। ঘুম, নিশ্চিন্ত ঘুম। বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কোনওমতে বলতে পেরেছিলেন, ‘গুড নাইট সুজয়।’ একুশ বছরের জুডিথ অলীক কল্পনাতেও ভাবেননি তখন, রাত্রি শুভ হওয়া তো দূরস্থান, চরম অভিশপ্ত হতে যাচ্ছে।