রণধীরের সঙ্গে সম্পর্কজনিত কোনও গল্প আছে ঘটনার নেপথ্যে? যদি বা থাকে, প্রমাণ কই? তা ছাড়া ওই পঞ্চান্ন বছরের একটা সিড়িঙ্গেমার্কা লোক আর সতেরো বছরের একটা মেয়ে মিলে চার-চারটে লোককে মেরে ফেলা কি সোজা নাকি? কীভাবে মারবে? কোনও চিৎকার-চেঁচামেচি কেউ শুনল না, কেউ কোনও প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন না, চারটে মানুষ স্রেফ লাশ হয়ে গেলেন? কীভাবে সম্ভব?
কীভাবে সম্ভব, তার একটা আভাস প্রথম পেলেন সিআইডি-র তরুণ সাব-ইনস্পেকটর প্রবীর সান্যাল। যিনি তদন্তকারীদের ‘কোর’ টিমে যোগ দিয়েছিলেন ঘটনার মাসখানেক পর। প্রবীরের সুবিধে ছিল, বাড়ি নৈহাটিতে। নোয়াপাড়া-জগদ্দল-নৈহাটি, এই অঞ্চলের বহু মানুষকে চিনতেন, জানতেন। পরিচিতি ছিল সর্বস্তরে। এমনই এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে একদিন সান্ধ্য আলাপচারিতার মধ্যে কথায় কথায় বেরিয়ে এল না-জানা তথ্য। ভদ্রলোক বললেন, ‘কী ট্র্যাজিক, না? একটা পরিবার শেষ হয়ে গেল। একটা মেয়ে একরাতের মধ্যে অনাথ হয়ে গেল পুরোপুরি। আমরা তো ওই পাড়াতেই থাকি। মেয়েটার সঙ্গে রেবার দেখা হয়েছিল ইনসিডেন্টটার কয়েকদিন আগেই। পালবাড়ির পাশের মাঠে মর্নিং ওয়াকের সময়। কী একটা গিনিপিগ না কি ফেলতে এসেছিল।’
গিনিপিগ? সুদীপা ফেলতে এসেছিল বাড়ির পাশের মাঠে? স্নায়ু মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠেছিল প্রবীরের। রেবা মানে ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী, যাঁর সঙ্গে সেদিনই কথা বললেন প্রবীর, ঠিক কী হয়েছিল? রেবা জানালেন, পালবাড়িতে ওই মর্মান্তিক ঘটনার কয়েকদিন আগে মর্নিং ওয়াকের সময় মাঠে সুদীপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। সুদীপা একটা পলিথিনের প্যাকেট থেকে মাঠে কিছু একটা ফেলছিল। রেবা স্বাভাবিক কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে, কী খবর? কী ফেলছিস?’ সুদীপা বলেছিল, ‘এই তো কাকিমা, বায়োলজির প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার জন্য দুটো গিনিপিগ ছিল বাড়িতে। মরে গেছে। ফেলতে এসেছি।’
ইতিমধ্যে পুলিশের হাতে এসে গিয়েছিল ফরেনসিক-বিশেষজ্ঞ প্রোফেসর ড. রবীন বসুর রিপোর্ট। যাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ভিসেরায় বিষক্রিয়ার স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায়নি ঠিকই । কিন্তু তার মানে এই নয়, যে বিষ প্রয়োগ হয়নি। সময়ের ব্যবধানে ভিসেরায় না-ই পাওয়া যেতে পারে বিষচিহ্ন, কিন্তু সেক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে ময়নাতদন্তের সময় দেহে পাওয়া লক্ষণসমূহে। যা এক্ষেত্রে পরিষ্কার জানান দিচ্ছে, ‘সায়ানাইড’ গোত্রের বিষ মৃতদের দেহে ঢুকেছিল।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নয়, বিষেই মৃত্যু। কীভাবে মেশানো হল বিষ? আর সুদীপার বাড়িতে গিনিপিগই বা এল কী করে? পোষার জন্য কেউ গিনিপিগ রাখে না বাড়িতে। তা ছাড়া স্কুল থেকে কখনও গিনিপিগ সরবরাহ করা হয় ছাত্রছাত্রীদের, বাড়িতে কাটাছেঁড়ার জন্য? কেউ কখনও শুনেছে? গিনিপিগগুলো মরলই বা কী করে? পরীক্ষানিরীক্ষা? বিষ প্রয়োগ?
যে সুদীপা এতদিন নানা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে চলেছিল লাগাতার, কখনও কেঁদে, কখনও সারাদিন অভুক্ত থেকে, কখনও শোকস্তব্ধতার অভিনয় করে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে চলেছিল, ‘গিনিপিগ-প্রসঙ্গ’ উঠতেই সেই সুদীপা আমতা-আমতা করতে শুরু করল। চোখেমুখে স্পষ্টতই দেখা দিল ভয়-দুশ্চিন্তা-আতঙ্ক। এরপর ঘণ্টাখানেকের জিজ্ঞাসাবাদ এবং স্বীকারোক্তি। স্তব্ধ হয়ে শুনলেন অফিসাররা। এমন ঘটনা এরাজ্যে এর আগে হয়নি নিশ্চিত। সম্ভবত দেশেও হয়নি। কী-ই বা বিশেষণ ব্যবহার করা যায়, ‘বিরলতম’ ছাড়া?
যে থালায় কালোজাম-সীতাভোগ সাজিয়েছিল সুদীপা, সেটা উদ্ধার হল বাড়ির লাগোয়া মাঠের ঝোপের মধ্যে থেকে। ফরেনসিক পরীক্ষায় সেই থালায় পাওয়া গেল সায়ানাইড গোত্রের বিষকণা। গ্রেপ্তার হলেন সুদীপা-রণধীর-কৃষ্ণেন্দু। খুন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অপরাধে সহায়তা এবং প্রমাণ লোপাটের মামলা দায়ের হল তিন ধৃতের বিরুদ্ধে। রণধীর-কৃষ্ণেন্দু সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন ঘটনার সঙ্গে তাঁদের কোনওরকম সংস্রব।
সুদীপা সবটাই খুলে বলেছিলেন পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে। কিন্তু মুশকিল হল, পুলিশকে দেওয়া বয়ান আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয় না, যদি না সেই বয়ানের সত্যতা অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তর্কাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। সুদীপা এখন যা বলছে, সেটা পরে কোর্টে অস্বীকার করলে মামলা বিশ বাঁও জলে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এখন পর্যন্ত যা খেল দেখিয়েছে এই মেয়ে, কিছুই অসম্ভব নয়। সুদীপার স্বীকারোক্তিই এই মামলার বুনিয়াদ। যা একেবারেই অটুট থাকবে না, যদি সুদীপা কোর্টে হেরফের করে বয়ানের। দোষীদের সাজা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে এক ধাক্কায়। আবার, পুলিশকে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অনড় থাকলে নিজেকেও যে জেলে পচে মরতে হবে, সেটা না বোঝার মতো বোকা ছিল না সুদীপা। বারবার বলত প্রবীরকে, ‘আমি তো সব স্বীকার করেছি… সব বলে দিয়েছি… কিন্তু সে জন্য আমার ফাঁসি হবে না তো?’ অফিসাররা আশঙ্কায় ছিলেন সুদীপার মতিগতি নিয়ে।
একটাই উপায় ছিল এই আশঙ্কা দূর করার। সেটাই প্রয়োগ করা হল। দেবব্রত-দুলাল-প্রবীররা বোঝালেন সুদীপাকে, ‘সারাটা জীবন পড়ে আছে তোমার সামনে। সেটা যাতে জেলে পচে নষ্ট না হয়, সেটা নিশ্চিত করার একটাই পথ আছে। রাজসাক্ষী হয়ে যাও। আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করো। আইনে বিধি আছে, রাজসাক্ষীদের অপরাধ মকুব হয়ে যায়। ভেবে দেখো ভাল করে। যা করেছ, সাজা হবেই। হয় ফাঁসি, নয় যাবজ্জীবন। তার চেয়ে দোষ স্বীকার করে নেওয়া ভাল নয় কি? বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে, এই যা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যাপার। তারপরই ছাড়া পেয়ে যাবে। সেটাই নিয়ম।’