সুদীপা মিষ্টির থালাটা সন্তৰ্পণে ফেলে এল বাড়ি-সংলগ্ন মাঠের এক প্রান্তে, ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে। তারপর ব্যাগে রাখা দড়ি দিয়ে সুদীপাকে পিছমোড়া করে বাঁধলেন রণধীর। মুখেও বাঁধলেন কাপড়। যা নিয়ে এসেছিলেন ব্যাগেই। রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ সদর দরজার বাইরে ফেলে এলেন সুদীপাকে, ‘আমি চললাম, আরও অন্তত ঘণ্টাখানেক চুপচাপ থেকে তারপর আওয়াজ কোরো। পুলিশকে কী বলতে হবে, ভুলে যেয়ো না।’
আওয়াজের উৎস প্রতিবেশীরা আবিষ্কার করলেন মধ্যরাতে। পুলিশ এল। সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারের চারজন খুন। বাড়ির একমাত্র কিশোরী কন্যা উদ্ধার হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায়। শোরগোল পড়ে গেল। ঘটনার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে মামলার দায়িত্ব নিল সিআইডি। ইছাপুরের ‘পালবাড়ি’ রাতারাতি পরিণত হল দ্রষ্টব্য স্থানে।
.
সিআইডি-র তরফে তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সাব-ইনস্পেকটর দুলাল সোম। ইনস্পেকটর দেবব্রত ঠাকুর ছিলেন তত্ত্বাবধানে। ক্লোরোফর্মের একটা শিশি, কিছু তুলো আর লাশে জড়ানো তামার তার ছাড়া বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু বাজেয়াপ্ত হয়নি পালবাড়ি থেকে। ভাবা গিয়েছিল, হাতের ছাপ কিছু অন্তত পাওয়া যাবে ঘরের আলমারি-দেরাজ থেকে। পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে যথেষ্ট ধোঁয়াশা ছিল। বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দেহের কাটাছেঁড়া করে যা দেখা গেছে, বিষক্রিয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ‘viscera’ (দেহের অঙ্গাংশ, মূলত বুক এবং পেটের) সংরক্ষিত করে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট মতামত মেলেনি প্রাথমিক পোস্টমর্টেম রিপোর্টে। বিভ্রান্তি থেকেই গিয়েছিল।
বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছিল সুদীপাও। ঘটনার পরের দিন পিসি-পিসেমশাই নিজেদের উত্তর কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুদীপাকে। কখনও সেখানে গিয়ে সুদীপার সঙ্গে কথা বলতেন তদন্তকারীরা, কখনও গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসা হত সিআইডি-র নৈহাটির অফিসে। সুদীপাই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আপাতদৃষ্টিতে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে কল্পনাতীত ছিল, প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নিজের মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে সতেরো বছরের কোনও নাবালিকা! আততায়ীদের সন্ধান পেতে সুদীপার বয়ানের উপরেই ভরসা করা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না পুলিশের। যখন নৈহাটির অফিসে সুদীপার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন অফিসাররা, খুবই সতর্ক থাকতেন, যাতে মেয়েটির মনের উপর কোনওরকম চাপ না পড়ে। যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা যায় সদ্য পরিবার-হারা কিশোরীকে, সে চেষ্টায় ত্রুটি রাখতেন না তদন্তকারীরা। ‘আহা রে, একেবারে অনাথ হয়ে গেল বেচারি’—এই ছিল মনোভাব।
সুদীপা শুরুতে গল্পটা যেভাবে সাজিয়েছিল, বলি। সাত-আটজন দশাসই চেহারার লোক রাত্রে ঢুকে পড়েছিল বাড়িতে। সবার হাতে ছুরি বা পিস্তল ছিল। এদের সবারই মুখ বাঁধা ছিল। এদের সঙ্গে সুভাষের তর্কাতর্কি হয় চোরাই সোনাদানা নিয়ে। সুভাষ নাকি গোপনে সোনার চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রাতের দিকে মাঝেমাঝেই সুভাষের কাছে কিছু লোক আসত। চোরাই জিনিসপত্র নিয়ে আলোচনা করত। এরাই সম্ভবত এসেছিল। ওরা সুভাষের কাছে পাওনাগন্ডার হিসেব চায়। তর্কাতর্কি হয় কিছুক্ষণ। তারপর ওরা ছুরি-পিস্তল তুলে সবাইকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। ঘরদোরের আলমারি সব তছনছ করে। টাকাপয়সা-গয়নাগাটি সব নিয়ে ব্যাগে পুরে নেয়। সুভাষ একসময় বলেন, ‘পুলিশকে জানিয়ে দিলে তোরা বাঁচবি ভেবেছিস?’ তখন ডাকাতরা বাবা-মা-দাদু-ঠাকুমার মুখ চেপে ধরে শরীরে তামার তার জড়িয়ে প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে দেয়। আর সুদীপাকে বেঁধে ঘরের বাইরে ফেলে রেখে যায়।
এই প্রাথমিক বয়ানে সুদীপা অনড় ছিল দিন দশেক। তারপর ফের গল্প ফাঁদে কোনও এক ‘স্বপন’-এর। বলে, এখন মনে পড়েছে, যারা এসেছিল ডাকাতি করতে, তাদের মধ্যে একজনকে নাকি সুভাষ ‘স্বপন’ বলে ডেকেছিলেন। ‘স্বপন’ নামে কোনও দাগি ডাকাত আছে কিনা, সেই খোঁজে ছুটে বেড়ালেন সিআইডি অফিসাররা। তুলেও আনা হল ডাকাতির পূর্ব-ইতিহাস থাকা দু’জন ‘স্বপন’-কে। যাদের জেরা করে আধঘণ্টার মধ্যেই বোঝা গেল, কোনওভাবেই এরা যুক্ত নয় এই ঘটনার সঙ্গে।
‘স্বপন’-পর্ব মিটে গেলে সুদীপার মুখে উঠে এল কোনও এক ‘খান্না আঙ্কল’-এর কথা। যাঁর সঙ্গে সুভাষ নাকি পাথরের ব্যবসায় নামার কথা ভাবছিলেন। বিনিয়োগও করেছিলেন মোটা অঙ্কের টাকা। খোঁজখবর করা হল এ নিয়েও। কিছুই পাওয়ার কথা ছিল না। পাওয়া গেলও না।
নৈহাটির অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের সময় রণধীর প্রায়ই দেখা করতে আসতেন সুদীপার সঙ্গে। দীর্ঘদিনের গৃহশিক্ষক ছিলেন, বয়সে পিতৃতুল্য, আসতেই পারেন, একেবারে শুরুর দিকে এমনই ভেবেছিল পুলিশ। কয়েকদিন পরেই অবশ্য স্থানীয় মানুষের কানাঘুষোয় তদন্তকারী অফিসাররা জানলেন, শিক্ষক-ছাত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কের গণ্ডি ছাড়িয়েছিলেন রণধীর-সুদীপা। এ নিয়ে পালবাড়ির সামনে প্রকাশ্য অশান্তিও করেছিলেন রণধীর-পত্নী অলকা।
পুলিশ বুঝতে পারছিল, সুদীপার এই ঘনঘন বয়ান বদলানোটা অত্যন্ত গোলমেলে। মেয়েটা মিথ্যে বলছে, লুকচ্ছে অনেক কিছু। একবার বলছে, বাবা চোরাই সোনাদানার ব্যবসায় যুক্ত ছিল। একবার বলছে, বাবার পাথরের ব্যবসাও ছিল। কখনও ‘স্বপন’-এর নাম বলছে, কখনও আবার ‘খান্না আঙ্কল’-এর, যাদের কারও অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া ডাকাতরা এসে একটা পরিবারের চারজনকে মেরে লুঠপাট করে গেল, অথচ পরিবারেরই একজনকে ছেড়ে দিয়ে গেল? যে কিনা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যাকে বাঁচিয়ে রাখলে বরং চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা? সুদীপার গল্পে গোড়াতেই গলদ ছিল বিস্তর। কিন্তু শোকে মুহ্যমান এক নাবালিকাকে কড়া ধাঁচের পুলিশি জেরাও করা যাচ্ছিল না। দুটোর বেশি তিনটে পালটা প্রশ্ন করলেই কেঁদে ফেলছিল।