রণধীর বিলক্ষণ জানতেন, কী প্রতিক্রিয়া হবে মোহগ্রস্ত কিশোরীর। জানতেন, ব্যাকুল হয়ে তাঁর হাত চেপে ধরবে সুদীপা, ‘না না স্যার, কী বলছেন আপনি? আমি রেডি।’ রণধীর নিজের হাতে সুদীপার হাতটা তুলে নিলেন, ‘আমি জানতাম সোনা, তুমি পারবে। সব মনে আছে তো তোমার? তা হলে কাল বাদে পরশু।’
কাল বাদে পরশু। ২০ মার্চ, ১৯৯১। বুধবার। ব্যারাকপুর স্টেশনে সকালে দেখা করলেন সুদীপা-রণধীর। ট্রেনে করে শিয়ালদা। সেখান থেকে বাসে ধর্মতলা। কে সি দাশের মিষ্টির দোকান থেকে পাঁচটা কালোজাম আর একশো গ্রাম সীতাভোগ কিনলেন রণধীর। দুপুরের খাওয়াটা দু’জনে সারলেন তালতলার এক হোটেলে। খেতে খেতেই সুদীপাকে পাখিপড়া করে বোঝালেন প্ল্যানের খুঁটিনাটি। শেষে বললেন, ‘মনকে শক্ত করো। দেখবে, আমরা নতুন করে বাঁচব।’
উত্তর দিতে গিয়ে গলা সামান্য কেঁপে গেল সুদীপার, ‘হ্যাঁ।’ সে কম্পন টের পেলেন রণধীর। এবং উপেক্ষা করলেন। ফিরে যাওয়ার আর রাস্তা নেই। সব ঠিকঠাক চললে পালবাড়ির যাবতীয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ আসতে চলেছে তাঁর হাতে।
নোয়াপাড়া ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল রণধীর-সুদীপার। বাড়ি ফিরলেন দু’জনেই। পালবাড়ির সদর দরজা সাধারণত রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার আগে বন্ধ হয় না। ভেজানোই থাকে দরজা। রাত পৌনে আটটায় রণধীর ঢুকলেন পালবাড়িতে। হাতে দুটো মিষ্টির বাক্স। কাঁধে একটা ব্যাগ। সুলেখা তখন একতলার রান্নাঘরে। একতলাতেই নিজেদের ঘরে রয়েছেন দেবেন্দ্র-লতিকা। টিভি দেখছেন। সুভাষ আছেন দোতলায় নিজেদের শোবার ঘরে। কাজ সেরে ফিরেছেন একটু আগে। খাটে শুয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন।
রণধীর সোজা উঠে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। সুদীপা অপেক্ষাতেই ছিল। প্ল্যানমতো রান্নাঘর থেকে আগেই একটা থালা এনে রেখে দিয়েছিল নিজের দোতলার ঘরে। থালা হাতে মেয়ে আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে গদু মাস্টার, দু’জনকে একসঙ্গে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসলেন সুভাষ। অবাক যতটা, তার থেকেও বেশি বিরক্ত। টিউশনি ছাড়িয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম রণধীর এলেন এবাড়িতে। কোনওরকম যোগাযোগ না রাখতে তিনি যথেষ্ট কড়াভাবেই বলে দিয়েছিলেন রণধীরকে। তা সত্ত্বেও এভাবে বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ হাজির?
—না জানিয়ে এভাবে চলে এলাম সুভাষবাবু, ক্ষমা করবেন। আসলে আমি নতুন কাজ পেয়েছি একটা। বেলঘরিয়ার একটা স্কুলে হেড মাস্টারের চাকরি। আগামী পরশু জয়েন করব। আপনাদের বাড়ির সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক, তাই একটু মিষ্টি নিয়ে এলাম। আমি আর কখনও এই বাড়িতে আসব না, কথা দিচ্ছি। কোনও ভুল-বোঝাবুঝি রাখবেন না মনে প্লিজ়।
রণধীরের কথায় সুভাষ সামান্য অপ্রস্তুত। ততক্ষণে মিষ্টির বাক্স খুলে ফেলেছেন রণধীর। কালোজাম আর সীতাভোগ সুদীপা দ্রুত সাজিয়ে ফেলেছে থালায়। একটা কালোজাম সুভাষের হাতে ধরিয়েও দিয়েছে সুদীপা। মিষ্টি মুখে পুরলেন সুভাষ। এবং তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে মুখ বিকৃত হয়ে গেল যন্ত্রণায়। নীলাভ হয়ে এল শরীর। প্রতিটা কালোজামের উপরের পুরু অংশটা অল্প একটু ভেঙে সোডিয়াম সায়ানাইড আর মারকিউরিক ক্লোরাইড ভিতরে ভরে এনেছিলেন রণধীর। সীতাভোগেও ছিল বিষ মাখানো।
বিষ কাজ করল অব্যর্থ। একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না সুভাষ। ঢলে পড়লেন খাটেই। সুদীপা নির্বিকার সাক্ষী থাকল বাবার মৃত্যুর।
এবার টার্গেট সুলেখা। রান্নাঘরে রণধীর-সুদীপাকে ঢুকতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন সুলেখা। সুভাষকে যা বলেছিলেন একটু আগে, সেটাই রণধীর বললেন সুলেখাকে। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি সত্যিই অনুতপ্ত বউদি, প্লিজ় রাগ করে থাকবেন না। একটা মিষ্টি অন্তত খান, না হলে খুব দুঃখ পাব।’ সুলেখাও অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন রণধীরকে দেখে। তবু ভদ্রতার খাতিরে থালা থেকে একটা কালোজাম নিয়ে কামড় দিলেন। সুলেখা চিৎকার করতে পারেন, এই আশঙ্কায় ক্লোরোফর্মে ভেজানো রুমাল ব্যাগে এনেছিলেন রণধীর। সেটাও চেপে ধরলেন সুলেখার মুখে। স্বামীর মতোই পরিণতি হল সুলেখার। মৃত্যু এল চকিতে। সাক্ষী থাকল একমাত্র সন্তান।
রইল বাকি দুই। দেবেন্দ্রমোহন আর লতিকা। নাতনির সঙ্গে রণধীরকে ঢুকতে দেখে অবাক ওঁরাও। ওই একই নতুন চাকরির গল্প শোনালেন রণধীর। এবং ঠাকুমার মুখে কালোজাম গুঁজে দিল নাতনি। স্ত্রীর সারা শরীর যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে দেখে বিপদের আঁচ পেলেন দেবেন্দ্রমোহন। আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। উঠে বসতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না। রণধীর এক ধাক্কায় ঠেলে শুইয়ে দিলেন খাটে। চেপে ধরলেন হাত দুটো। জোর করে দাদুর মুখে সীতাভোগ ঠুসে দিল সুদীপা।
চারজন জলজ্যান্ত মানুষ মিনিটপাঁচেকের মধ্যেই লাশ হয়ে গেলেন। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল প্রায় একটা আস্ত পরিবার। সেই পরিবারেরই নাবালিকা মেয়ে আর তার প্রৌঢ় মাস্টারমশাইয়ের ষড়যন্ত্রে!
কাজ তখনও বাকি ছিল। ছকও কষাই ছিল। কাঁধের ব্যাগ থেকে রণধীর বের করলেন তামার তারের গোছা। পেঁচিয়ে বাঁধলেন চারজনের দেহে। তারের অন্য প্রান্ত গুঁজে দিলেন কাছাকাছির ইলেকট্রিক প্লাগ পয়েন্টে। যাতে মনে হয়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই মৃত্যু। পুড়ে গেল দেহগুলোর কিছু অংশ। এরপর একতলা-দোতলায় যত আলমারি-দেরাজ ছিল, তা থেকে জিনিসপত্র বের করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেন রণধীর। পুরোটাই করলেন সঙ্গে আনা গ্লাভস পরে, যাতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট না পাওয়া যায় কোথাও। ডাকাতির চেহারা দেওয়া হল গোটা বাড়িতে।