‘স্যার’ ওদিকে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বুঝে গিয়েছিলেন, পালবাড়িতে টিউশনির পাট চুকতে চলেছে। পরের দিনই সুভাষ বলে দিলেন সরাসরি, ‘আপনি আর আসবেন না মাস্টারমশাই। নানা কথা রটছে। আমাদের পাড়ায় থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বুড়িকে আপনার কাছে পড়াচ্ছিলাম, যাতে এইচএস-এ রেজাল্টটা ভাল করে। জয়েন্টে চান্স পায়। আজ ওর স্কুলে গিয়ে জানলাম, ও গত কয়েক মাসে স্কুলে যায়ইনি অর্ধেকদিন। আপনার ব্যাপারেও খোঁজখবর করলাম। শুনলাম, টানা অ্যাবসেন্ট করার জন্য আপনারও চাকরি গেছে নবাবগঞ্জের স্কুল থেকে। আপনি আমার মেয়ের অনেক ক্ষতি করেছেন। দোহাই, আর করবেন না। আমাদের পরিবারের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ না রাখলেই খুশি হব।’
সুভাষ কিসে খুশি হবেন না হবেন, সে নিয়ে তখন মাথা ঘামানোর সময় ছিল না রণধীর-সুদীপার। পাছে স্কুল থেকে বাবাকে জানিয়ে দেয়, তাই সপ্তাহখানেক নিয়মিত ক্লাস করল সুদীপা। তারপর ফের রণধীরের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা শুরু করল। মার্চের শুরুর দিকে একদিন ছাত্রীর হাতে একটা কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন রণধীর। বললেন, ‘তোমার মায়ের তো বলেছ হজমের সমস্যা। রোজ রাতে ইশবগুল খেতে হয়। এই প্যাকেটের মধ্যে কিছু গুঁড়ো আছে। সেটা আজ রাতে ওই ইশবগুলের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ো।’
—কী আছে এতে?
—পথের কাঁটা সরানোর ওষুধ। চল্লিশটা ক্যামপোজ় ট্যাবলেট গুঁড়ো করা আছে এতে। খেলে আর ঘুম ভাঙবে না তোমার মায়ের। কেউ যাতে দেখে না ফেলে, এইভাবে মিশিয়ে দিয়ো। লোকে ভাববে তোমার মা সুইসাইড করেছেন। মিটে গেল।
সুদীপা চুপচাপ শুনল। বাড়ি নিয়েও গেল ওই প্যাকেট। কিন্তু ওই গুঁড়ো ইশবগুলের গ্লাসে মেশানোর সাহস হল না শেষ পর্যন্ত। যা শুনে পরের দিন রণধীর হালকা বকাবকিই করলেন সুদীপাকে, ‘দেখো, এভাবে কিন্তু বেশিদিন চলবে না। তুমি তো জানোই, তোমাকে নিয়ে আমার বাড়িতেও সমস্যা হচ্ছে। শুধু তোমাকে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চাই বলে বাড়ির রোজকার অশান্তিও সহ্য করে চলেছি। এখন তুমি যদি সামান্য ঘুমের ওষুধ মেশাতেও এত নার্ভাস হয়ে পড়ো, তা হলে তো মুশকিল। তা ছাড়া আমি ভেবে দেখলাম, শুধু তোমার মা মারা গেলে আমাদের কোনও লাভ হবে না। তোমার বাবা কিছুতেই আমাদের আর মিশতে দেবেন না। তোমার দাদু-ঠাকুমাও বাধা দেবেন। ওঁরা বেঁচে থাকলে আমাদের একসঙ্গে থাকার স্বপ্নটা আর বেঁচে থাকবে না। এখন তোমাকে ঠিক করতে হবে তুমি কোনটা চাও। তুমি না চাইলে আমি আর যোগাযোগ রাখব না তোমার সঙ্গে।’
কিশোরীবেলার মোহ যে কী মারাত্মক বস্তু! সুদীপা এক সেকেন্ডও ভাবল না উত্তর দিতে, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তুমি যেমনটা বলবে, তেমনটাই করব। এবার পারিনি, পরের বার ঠিক পারব। দেখে নিয়ো তুমি।’ রণধীর বুকে টেনে নিলেন ছাত্রীকে। নিজের শরীরের সঙ্গে সুদীপাকে মিশিয়ে নিতে নিতে মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন পরবর্তী করণীয়। কালই দেখা করতে হবে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে। ফুলবাগানের সত্যবাবুর দোকানে যেতে হবে। আগে এক্সপেরিমেন্ট করে নিশ্চিত হয়ে নেওয়াটা জরুরি। বিষ বলে কথা!
সোডিয়াম সায়ানাইড আর মারকিউরিক ক্লোরাইড। রণধীরের অনুরোধে জোগাড় করে দিলেন কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণেন্দু জানা, বহুদিনের পরিচিত রণধীরের। নোয়াপাড়ারই একটি স্কুলে কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরিতে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করেন বছর পঁয়তাল্লিশের কৃষ্ণেন্দু। কলেজ স্ট্রিটে ‘Scientronic India’ নামের একটা ছোট দোকানও আছে। নানান ধরনের রাসায়নিক সামগ্রীর দোকান। খুব যে আমদানি হয় সে দোকান থেকে, এমন নয়।
কৃষ্ণেন্দুকে সব খুলে বলেছিলেন রণধীর। টোপ দিয়েছিলেন, ‘কাজটা হয়ে গেলে ভাগ্য খুলে যাবে আমাদের। পুরো সম্পত্তি মেয়েটাই পাবে। গয়নাগাটিই যা আছে শুনেছি, পাঁচ-দশ লাখ টাকার হবে। মেয়েটার বাবা রিসেন্টলি এনএসসি করেছে ছ’লাখ টাকার। বোঝ একবার ব্যাপারটা! একটা মোটা অঙ্কের শেয়ার তুইও পাবি। লাইফ বদলে যাবে।’
টাকার অঙ্ক শুনে মাথা ঘুরে গিয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর। রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বিষের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োগ করে নিশ্চিত হওয়াটা? ফুলবাগানে সত্য ঘোষের দোকানে রণধীরকে নিয়ে গিয়েছিলেন কৃষ্ণেন্দু। পশুপাখি নিয়েই সত্যবাবুর কারবার। দোকান থেকে কয়েকটা গিনিপিগ কিনেছিলেন রণধীর। সুদীপার সঙ্গে সেদিনই প্ল্যানমাফিক দেখা করেছিলেন ব্যারাকপুর আর্মি ক্যান্টনমেন্টের সামনে। দুটো ছোট শিশি দিয়েছিলেন সুদীপাকে। যাতে ছিল সোডিয়াম সায়ানাইড আর মারকিউরিক ক্লোরাইড। আর দিয়েছিলেন গিনিপিগগুলো, ‘এগুলো বাড়িতে নিয়ে যাও। বলবে, বায়োলজির প্র্যাকটিকালে ডিসেকশন-এর জন্য লাগবে। বিষটা কাল দিয়ে দেখবে, গিনিপিগগুলো মরে কিনা।’
মরল। বিষক্রিয়ায় তিনটে গিনিপিগই মরল। মৃত গিনিপিগগুলো সুদীপা ভোরবেলায় ফেলে দিয়ে এল বাড়ির লাগোয়া মাঠে।
কৃষ্ণেন্দুও আলাদাভাবে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন গিনিপিগের উপর। এবং রণধীরকে জানিয়েছিলেন, এ বিষ মনুষ্যদেহে প্রবেশ করার মিনিটখানেকের মধ্যেই মৃত্যু অবধারিত।
১৮ মার্চের দুপুর। সুদীপার সঙ্গে রণধীর দেখা করলেন টালা ব্রিজের কাছে। শেষবারের মতো যাচাই করে নিলেন সুদীপার মন, ‘তুমি পারবে তো? ভেবে নিতেই পারো, এখনও সময় আছে। পরে দোষ দেবে না তো আমাকে? তুমি যদি এতে রাজি না-ও হও, আমি তোমাকে এখন যেমন ভালবাসি, সারাজীবন তেমনই বাসব। দেখাসাক্ষাৎ না হয় না-ই বা হল।’