অকারণে যে নয়, শীঘ্রই বোঝা গেল অবশ্য। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সেটা। রণধীর এসেছেন। দোতলার ঘরে পড়াচ্ছেন সুদীপাকে রোজকার মতো। সুলেখা গিয়ে অন্যদিনের মতো চা-বিস্কুটও দিয়ে এসেছেন। রান্নার কাজ সারছেন একতলায়। হঠাৎ খেয়াল হল, পরের দিন নেমন্তন্ন আছে একটা। সন্ধেবেলা সবাই মিলে কল্যাণী যাওয়ার আছে। কাল পড়াতে আসার দরকার নেই, এটা বলে দেওয়া দরকার গদু মাস্টারকে।
ফের উপরে উঠলেন সুলেখা। এবং উঠে দোতলার বসার ঘরে ঢুকে যা দেখলেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন স্ট্যাচুবৎ। রণধীর সোফায় শুয়ে পড়েছেন। মাথাটা সুদীপার কোলে। সুদীপা তার স্যারের মাথায় ‘অম্রুতাঞ্জন’ মালিশ করে দিচ্ছে। মুখটা ঝুঁকে পড়েছে রণধীরের মুখের কাছে। দু’জনের ঠোঁটের মধ্যে স্রেফ হাইফেনের ব্যবধান।
মা-কে দেখে যেন ইলেকট্রিক শক খেল সুদীপা। ছিটকে সরে গেল দ্রুত। রণধীর আপ্রাণ চেষ্টা করলেন স্বাভাবিক থাকার, ‘আসলে হয়েছে কী বউদি, মাথাটা খুব ধরেছিল হঠাৎ। শিরাগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তাই সুদীপাকে বললাম…।’
সুলেখা নিজেকে প্রাণপণ সামলালেন, ‘শরীর খারাপ লাগছে যখন, বাড়ি চলে যান। এটা গৃহস্থবাড়ি, ডাক্তারখানা নয়।’ রণধীর ব্যঙ্গটা হজম করে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ক্রোধান্ধ সুলেখা বেল্ট দিয়ে বেদম মারলেন সুদীপাকে। দাগ হয়ে গেল পিঠে। রাতে সুভাষ ফিরতেই সুলেখা তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, ‘এই মাস্টারকে বিদেয় করো। পড়াতে এসে নোংরামো শুরু করেছে মেয়ের বয়সি ছাত্রীকে নিয়ে। লম্পট একটা! আর তোমার মেয়েও কম নয়…।’
স্ত্রী একটু শান্ত হতে সুভাষ বোঝালেন, নতুন মাস্টারের খোঁজ শুরু করবেন কাল থেকেই। সন্ধান পেলেই ছাড়িয়ে দেবেন রণধীরকে। টাকা শোধের জন্য অপেক্ষা করার আর প্রশ্নই উঠছে না। তবে সামনে ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। ততদিন সুদীপার পড়ার যাতে ক্ষতি না হয় সেটাও তো মাথায় রাখা দরকার। যতদিন না নতুন মাস্টার পাওয়া যাচ্ছে, বাড়িতে টিউশনির সময়টা একটু চোখে চোখে রাখতে হবে মেয়েকে।
পরের দিন যখন রণধীর ফের পড়াতে এলেন, দু’ঘণ্টায় অন্তত দশবার কোনও না কোনও অজুহাতে ঘরে ঢুকলেন সুলেখা। তার মধ্যেই অবশ্য স্যারকে সুদীপা জানিয়েছে বেল্ট দিয়ে মারের কথা। শুনে রণধীর উত্তেজিতভাবে বলেছেন, ‘এ তো চোরের মার! এমন মা থাকার থেকে না থাকাই ভাল। উনি চান না তোমার ভাল হোক। নেহাত আমার কাছে পড়ে ভাল রেজাল্ট করেছ আর তোমার বাবা আমাকে ছাড়াতে চান না বলে আমাদের দেখা হচ্ছে। কিন্তু যা বুঝছি, তোমার মা আমাকে তাড়িয়ে ছাড়বেন। নষ্ট করে দেবেন তোমার জীবনটা।’ সুদীপা প্রতিটা শব্দ শুনেছে মন দিয়ে। তারপর বলেছে, ‘সেটা আমি হতে দেব না। তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইলে মেরেই ফেলব মা-কে। ডাইনি একটা!’ রণধীরও সম্মতিতে মাথা নেড়েছেন, ‘ঠিক বলেছ। এমন মা থাকার থেকে না থাকাই ভাল। এভাবে চললে তো একটা উপায় বার করতেই হবে। বেশি দেরি করা যাবে না।’
’৯১-এর জানুয়ারির এক বিকেলে যা ঘটল, রণধীর-সুদীপার আর উপায়ও থাকল না বেশি দেরি করার। রণধীরের স্ত্রী অলকা এলেন পালবাড়িতে। তুমুল গালিগালাজ করে গেলেন পাড়াপ্রতিবেশী সবাইকে শুনিয়ে, ‘এমন মেয়ে আমার থাকলে গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতাম। বলিহারি যাই এমন বাপ-মায়ের। বাপের বয়সে মাস্টারের পিছনে মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে মজা দেখছে। আর লাইনেই যদি নামাতে হয়, ভদ্রপাড়ায় কেন? সোনাগাছিতে পাঠান।’
অপমানে সর্বাঙ্গ জ্বলে গিয়েছিল সুলেখার। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে ঘুমচ্ছিল। টেনে তুলেছিলেন চুলের মুঠি ধরে, কিল-চড়-থাপ্পড় খরচ করেছিলেন এলোপাথাড়ি, ‘ঠিকই তো বলে গেল, তোর মতো মেয়েকে পেটে ধরাটাও পাপ। পড়াশুনো করে দিগ্গজ হওয়া বার করছি তোর।’ মারের পর্ব শেষ হওয়ার পর মায়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সুদীপা। অদ্ভুত সে দৃষ্টি! যাতে অভিমান তো নয়ই, ক্ষোভ-রাগ-দ্বেষও নয়, ঠিকরে পড়ছিল স্রেফ প্রতিহিংসা।
সুদীপার সে রাতটা কাটল নিদ্রাহীন, সাত-পাঁচ ভাবনায়। স্যারের স্ত্রীর কী দরকার ছিল বাড়ি বয়ে এসে এইসব বলার? এরপর স্যারকে নির্ঘাত ছাড়িয়েই দেবে বাবা। রোজ তো লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করা যায় না বাইরে। বাড়িতে টিউশনির নামে তবু দেখা হত সপ্তাহে চারদিন। স্যারকে না দেখে সে থাকবে কী করে? বাবা বলল, কাল নাকি স্কুলে যাবে। গেলে তো জানতেই পারবে, গত তিন মাসে অর্ধেকদিন স্কুলেই যায়নি সে। মানে, আরও এক প্রস্থ বকাবকি। আবার মারধর।
সারা পৃথিবীটাই শত্রু হয়ে গেছে যেন হঠাৎ। কেউ বাদ নেই। মায়ের বকাঝকায় না হয় তার অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা? যে বাবা কোনওদিন চেঁচিয়ে কথা বলেনি তার সঙ্গে, সেই বাবাও তো তাকে খুব বকেছিল সেদিন। ওই যেদিন স্যারের মাথায় ‘অম্রুতাঞ্জন’ মালিশ করার সময় মা দেখে ফেলেছিল। আজ বাড়ি ফিরে সব শুনে বাবাও কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। মা তাকে অত মেরেছে জেনেও একবারও কথা পর্যন্ত বলেনি এখনও।
আর দাদু-ঠাকুমাই বা কী! রোজ রাতে শোবার আগে সে একবার দাদু-ঠাকুমার কাছে যায়। ওঁরা আদর করে দেন। তারপর সে উপরে শুতে আসে। আজ রাগে-দুঃখে সে যায়ইনি নীচে। শুয়ে পড়েছে। কই, দাদু-ঠাকুমাও তো উপরে এল না একবার? বাবা ফিরে আসার পর মা যখন চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল, দাদু-ঠাকুমাও তো চুপ করে ছিল। কিছু তো বলল না? স্যার ছাড়া আর কেউ তার ভাল চায় না। বাকি সবাই শত্রু, সবাই। মরে যাক, সবাই মরে যাক। তার কাউকে চাই না। শুধু স্যার পাশে থাকলেই হবে।