শেষ নামটা অন্যদের তুলনায় কিছু বাড়তি শব্দ দাবি করে। নেপু— নেপু গিরি। কিছু লোকের বোধহয় জন্মই হয় অপরাধ-লগ্নে। নেপু যেমন। ‘বর্ন ক্রিমিনাল’ গোত্রের । শুধু বলার অপেক্ষা, ‘নামিয়ে দিয়ে আয় তো নেপু।’ কোনও প্রশ্ন না করে যাকে ‘নামানোর’ নির্দেশ এসেছে, তাকে খুন করে আসবে নির্মম নির্বিকার। এমন পেশাদার খুনির দরকার ছিল শ্যামলের।
‘খুন’ ব্যাপারটা অবশ্য নেপুর থেকেও ঢের বেশি মজ্জাগত ছিল শ্যামলের। অপরাধ-বিজ্ঞানের খটোমটো পরিভাষায় বললে, শ্যামল ছিল ‘প্যাথলজিকাল কিলার’। আনন্দ পেত খুন করে। হয়তো প্রাণে মেরে ফেলার দরকারই নেই কাউকে, স্রেফ ধমকধামকই যথেষ্ট, তবু শ্যামল বিজাতীয় তৃপ্তি পেত ‘লাশ ফেলে দিয়ে’। মদের সঙ্গে গাঁজার নেশা জমে উঠলে বাবু হয়ে বসে থাকত স্থির। বদলে যেত চোখের দৃষ্টি। কথা প্রায় বলতই না। এমন একটা বোমভোলা চেহারা হত যে, সঙ্গীরাই বলত, ‘দ্যাখ… দাদা পুরো হুব্বা হয়ে গেছে!’
সেই থেকেই নামকরণ। হুব্বা। হুব্বা শ্যামল। নেশার ঘোরে থম মেরে ‘হুব্বা’ হয়ে থাকার সময়টাতেই শ্যামল ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক। তখনই মাথাচাড়া দিত কারণে-অকারণে রক্ত দেখার তাড়না, লাশ দেখার স্পৃহা—‘ধুর… এসব মদ-ফদ মায়া… আমার কিসে চলকায় জানিস… মার্ডারের পর যখন গরম রক্তটা মুখে ছিটকে এসে লাগে না… আঃ… বুঝবি না তোরা…!’ রমেশ-বাপি-মন্টুর মতো ঘনিষ্ঠরা শ্যামলের এই রক্ত দেখার রাত্রিকালীন ছটফটানিটা জানত। বছরের পর বছর ধরে সঙ্গে থাকার ফলে আঁচ করতে পারত, ওইসময় আশেপাশে বিরোধী গ্ৰুপের ছেলে পেলে তো কথাই নেই, এমনকী নিজের গ্ৰুপের ছেলেছোকরাদের উপরও যখন-তখন চড়াও হয়ে যেতে পারে শ্যামল। রমেশ টিমের জুনিয়রদের বলেই রেখেছিল, ‘শ্যামল যদি কোনওদিন রাত সাড়ে দশটার পর ডাকে, আসবি না। না এলে দাদা রাগ করবে, এই ভয়ে দুম করে চলে আসবি না কিন্তু। বেশি রাতে ডাকলে আসবি না, ব্যস। দাদা রাগ করলে করবে। সেটা আমি সকালে বুঝে নেব।’
হাতে যথেষ্ট টাকা। দুর্ধর্ষ গ্যাং-ও তৈরি এই ক’বছরে। শ্যামল সিদ্ধান্ত নিল, ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার এটাই সেরা সময়। কোন্নগর-ধৰ্মডাঙায় শ্যামলের, সরি, হুব্বা শ্যামলের সদলবল পুনঃপ্রবেশ ঘটল এলাকাছাড়া হওয়ার প্রায় এক দশক পরে। ৯৫-’৯৬-এ, নয়ের দশকের মাঝামাঝি। লক্ষ্য মূলত দুটো। প্রথম, রিষড়ায় সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া বিন্দাল ফ্যাক্টরিতে পড়ে থাকা লক্ষ লক্ষ টাকার মাল পাচার। দ্বিতীয়, হুগলি-হাওড়ার অপরাধ দুনিয়ায় ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে ওঠা।
প্রথম লক্ষ্যপূরণে অভিনব পন্থা নিল শ্যামল। নিজে বা নিজের টিমের ছেলেপুলেদের দিয়ে ফ্যাক্টরির মাল চুরি আর পাচার আর নয়। ওসব কেরিয়ারের শুরুর দিকে অনেক হয়েছে। এবার চুরিটা অন্যরা করুক, কিন্তু নিজের টিমের নজরদারিতে।
কীরকম? শ্যামল নিয়ম বেঁধে দিল। জটিল কিছু নয়। বিন্দাল ফ্যাক্টরির মাল যে কেউ চুরি করতে পারে। অবারিত দ্বার। কিন্তু চুরির পর বেচতে হবে শ্যামলের কাছেই। এবং বাজারদরের থেকে অর্ধেক দামে। এক কেজি ছাঁটের বাজারদর যদি তিনশো টাকা হয়, ফ্যাক্টরি থেকে সরানো সেই এক কেজি শ্যামলকে বেচতে হবে দেড়শো টাকায়। অর্ধেক দামে কিনে নেওয়া সেই মাল এবার শ্যামল বাজারে বেচত চলতি দরে।
এই সিস্টেমের প্রতিবাদ করার মানে পৃথিবী থেকেই ‘খরচা’ হয়ে যাওয়া, জানত সবাই। জানত, শ্যামলের সঙ্গে এই কেজি প্রতি দেড়শো টাকাটা অন্তত দুশো করতে চেয়ে একজন তর্কাতর্কি করেছিল। পরিণতি ভাল হয়নি। বুকে সোজা পিস্তল ঠেকিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় শ্যামল বলেছিল, ‘পাঙ্গা নেওয়ার আগে তোর একটা জিনিস মনে রাখা উচিত ছিল। গাড়িটা তুই চালাচ্ছিস না। আমি চালাচ্ছি।’ এরপর দুটো গুলি খরচ করেছিল শ্যামল। ‘পাঙ্গা’-নেওয়া লোকটির ‘বডি’ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশের খাতায় ‘মিসিং’। জনশ্রুতি, লাশটা রেললাইনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
হাজার হাজার টনের অরক্ষিত এবং পরিত্যক্ত মাল এভাবে বেচে খুব দ্রুত টাকার পাহাড়ে পা রাখল শ্যামল। অতঃপর দ্বিতীয় লক্ষ্য। এলাকায় নিজের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে শিলমোহর দেওয়া।
খুব সোজা হল না ব্যাপারটা। অপরাধ জগতে শূন্যস্থান ‘শূন্য’ থাকে না বেশিদিন। এলাকায় প্রায় এক দশক ধরে শ্যামলের অনুপস্থিতির সুযোগে তৈরি হয়ে গিয়েছিল একাধিক ছোট-বড় গ্যাং। যাদের মধ্যে শ্যামলের দিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো বুকের পাটা একজনেরই ছিল। বাঘা। ভাল নাম, ভোলানাথ দাশ। যে একসময় ছিল শ্যামলেরই টিমে। বখরা নিয়ে ঝামেলায় দল ছেড়েছিল। কোন্নগর পেরিয়ে কানাইপুরে ঢুকলেই বাঘার এলাকা শুরু।
’৯৭-৯৯, এই সময়টায় শ্রীরামপুর মহকুমার পুলিশ প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল শ্যামল-বাঘার টক্কর, এলাকা দখলের লড়াই, খুন-পালটা খুন, বোমাবাজি, রক্তপাত। খুনোখুনি কখনও কখনও এতটাই মাত্রা ছাড়াত যে ঘটনার আঁচ মহকুমা বা জেলা পেরিয়ে পৌঁছে যেত কলকাতাতেও। জায়গা করে নিত শহরের বাংলা-ইংরেজি খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। একবার যেমন হল। শ্যামলের গ্ৰুপের দুটো ছেলেকে রাতের দিকে একলা পেয়ে কুপিয়ে মেরে দিল বাঘার ছেলেরা। পরের রাতেই বদলা নিল শ্যামল। বাঘার পাড়াতে দলবল নিয়ে ঢুকে চূড়ান্ত তাণ্ডব করল। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিল বাঘার বাড়ি। বাঘা কোনওমতে জনাদুয়েক সঙ্গীকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচল। পালাতে পারেনি চারজন। তারা বাঁচল না। তাদের কুপিয়ে পিস পিস করে কেটে স্থানীয় পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে গেল শ্যামল।