আরও একটু ভালভাবে বাঁচতে অগত্যা ওয়াগন ভাঙা আর টুকটাক ছিনতাই। ‘টুকটাক’-এর গণ্ডি অবশ্য দ্রুতই পেরল বছর আঠারোর শ্যামল। কোন্নগরের একটা ফ্যাক্টরির টাকা নিয়ে সংস্থার এক কর্মী সাইকেলে করে সন্ধেবেলা ফিরছিলেন। শ্যামল আটকাল কোন্নগর আন্ডারপাসের মুখে, ‘টাকার ব্যাগটা দে!’ ওই কর্মী প্রতিবাদ করলেন, ‘এটা আমার টাকা নয়। কোম্পানির টাকা। তা ছাড়া যারই টাকা হোক, তোকে দেব কেন? তুই কে? কোন হরিদাস?’ বলামাত্রই শ্যামল সোজা ছুরি ঢুকিয়ে দিল পেটে। এবং টাকার ব্যাগ নিয়ে চম্পট।
ওটাই প্রথম খুন। পুলিশের খাতায় ছিঁচকে ছিনতাইবাজ থেকে দাগি দুষ্কৃতীতে উত্তরণের ওটাই প্রথম ধাপ। সেই প্রথম পুলিশের তাড়ায় সাময়িক পালিয়ে যাওয়া এলাকা থেকে। থানায় থানায় ‘রাফ রেজিস্টার’ বলে একটা খাতা থাকে। যাতে নথিবদ্ধ রাখা হয় এলাকার দুষ্কৃতীদের নাম। সেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে সেই প্রথম জায়গা পেল শ্যামল। চেহারার বর্ণনায় (পুলিশি ভাষায়, ‘ডেস্ক্রিপটিভ রোল’) লেখা হল, বেঁটে, হাইট পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি। গায়ের রং চাপা। ছিপছিপে চেহারা।
অপরাধী হিসেবে ‘গুরুত্ব’ যে ক্রমশ বাড়বে আরও, প্রথম খুনের মাসদুয়েকের মধ্যেই সেটা জানান দিল শ্যামল। কোন্নগর-নবগ্রাম এলাকায় পরপর কয়েকটা ডাকাতি করে। দাদা বাচ্চু এবং কিছু উঠতি চ্যাংড়াকে সঙ্গে নিয়ে মাঝরাতে গৃহস্থবাড়িতে ঢুকে বেপরোয়া লুঠপাট। কেউ প্রতিরোধ করলে এলোপাথাড়ি মারধর।
লোহাচুরি-টুরি অনেকেই করে। কিন্তু এই আঠারো-উনিশ বছরের ছেলেটা তো নিজের পাড়ার আশেপাশেই ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে! স্থানীয় মানুষ উত্তরপাড়া থানায় ডেপুটেশন দিলেন। প্রতিদিন অন্তত দু’বার করে শ্যামলের ধর্মডাঙার বাড়িতে শুরু হল পুলিশি রেইড। প্রতিটা ঘরের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তল্লাশি। শ্যামলের বাবা-মাকে পুলিশ স্পষ্ট বলে এল, ‘ছেলেকে বলুন সারেন্ডার করতে। না হলে রোজ এভাবে বাড়িতে পুলিশ আসবে যখন-তখন, লাইফ হেল হয়ে যাবে আপনাদের।’
বাড়ির চাপ। পুলিশের চাপ। এলাকার মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সামাজিক চাপ। পাড়াছাড়া হতে বাধ্য হল শ্যামল। সেটা আটের দশকের শেষ ভাগ, ’৮৬-৮৭। মা-বাবা-ভাইদের প্রতি কোনও পিছুটান ছিল শ্যামলের, এমন অভিযোগ কখনও কেউ করতে পারেনি। প্রবল পিছুটান বরং ছিল অন্যত্র। পাড়ারই এক কিশোরীর সঙ্গে প্রেম গত কয়েক বছর ধরে। নাম তাপসী। যার পরিবারের ঘোর আপত্তি ছিল একজন সমাজবিরোধীর সঙ্গে মেয়ের মেলামেশায়। পাড়াছাড়া হওয়ার পর এক বন্ধু মারফত ক্লাস এইটের তাপসীকে বার্তা পাঠাল শ্যামল, ‘কয়েকটা বছর শুধু ধৈর্য ধরে থাকো…।’ কথা রেখেছিল শ্যামল। বছরদুয়েকের মধ্যেই এক রাতে ঝটিতি অভিযানে দলবল নিয়ে ঢুকেছিল পাড়ায়। তাপসীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেছিল পরের দিনই।
সমাজবিরোধী তো অনেকই থাকে। কিন্তু গুন্ডামি-মস্তানির প্রচলিত সীমানা পেরিয়ে যদি কোনও সমাজবিরোধীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ‘বাহুবলী’ হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি থাকে, পৃষ্ঠপোষকের বড় একটা অভাব হয় না আমাদের সমাজে। ছাতা একটা জুটেই যায় ঠিক। জুটে গেল শ্যামলেরও। দক্ষিণ শহরতলির এক রাজনৈতিক নেতার বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠল। ঘাঁটি গাড়ল মহেশতলায়।
পরের ছ’-সাত বছর হুগলিতে পাকাপাকিভাবে ঢুকতে না পারলে কী হবে, রাজ্যের অন্যত্র এবং কখনও কখনও রাজ্যের বাইরেও একটার পর একটা ক্রাইম করে বেড়িয়েছিল শ্যামল। কী নেই অপরাধের সেই দশকর্ম ভাণ্ডারে? হাওড়ার বন্ধ কারখানার লোহার ছাঁট পাচার। দূরপাল্লার ট্রেনে প্যাসেঞ্জার সেজে উঠে গভীর রাতে ডাকসাইটে ডাকাতি। বেপরোয়া বোমাবাজি করে এলাকা দখল কোনও রাজনৈতিক দাদার অঙ্গুলিহেলনে। মোটা টাকার বিনিময়ে ‘সুপারি-কিলিং’।
এমনই এক সুপারি-কিলিং করতে গিয়ে নয়ের দশকের শুরুতে মুঘলসরাইয়ে রেলপুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল শ্যামল। মাসখানেকের জেলযাত্রার পর বেরিয়ে এসে ফের নতুন উদ্যমে শুরু করেছিল দাদাগিরি। চেহারাটাও বদলে গেছিল এই কয়েক বছরে। ছিপছিপে ছিল না আর। শরীরে জমছিল সমৃদ্ধির মেদ। এই শ্যামলের ‘ডেস্ক্রিপটিভ রোল’ লিখতে হলে ‘ছিপছিপে’ বদলে গিয়ে হত ‘গাট্টাগোট্টা, সামান্য মোটার দিকে’।
‘গ্যাং’ থাকলে তবেই না গ্যাংস্টার! শ্যামল একটু একটু করে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব গ্যাং। হাওড়ার কুখ্যাত সাট্টা-কারবারি রাম অবতারের কাছে সাট্টার প্যাড লেখার কাজ করত রমেশ মাহাতো। কিন্তু স্বপ্ন দেখত ‘বড়’ মাঠে খেলার। প্যাড লেখে তো পাতি পাবলিক, ক’পয়সাই বা হয়? বালি-বেলুড়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটা জুয়ার ঠেকে শ্যামল-রমেশের আলাপ। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব, এবং সেই বন্ধুত্ব গভীরতর হয়ে শ্যামলের গ্যাংয়ের অলিখিত নাম্বার টু হয়ে ওঠা রমেশ মাহাতোর।
নাম্বার থ্রি? ‘বেনারসি বাপি’। আসলে বাঙালি। নাম, বাপি খাস্তগির। বেনারসে জন্ম এবং বড় হওয়া বলে নাম ‘বেনারসি’। শ্যামলের সঙ্গে প্রথম দেখা লিলুয়ার বিজলি কোয়ার্টারে, যেখানে দুষ্কৃতীদের নিত্য যাতায়াত। লম্বায় ছ’ফুট, নির্মেদ শরীরের বাপিকে দলে নিতে একটুও ভাবতে হয়নি শ্যামলকে। গ্যাংয়ের অন্যদের অনেকেরই নাম করা যায়। লম্বা লিস্ট। তবে ‘কোর গ্ৰুপ’ বলতে মন্টু, সত্য, পুতন, চিকুয়া, জিতেন্দর, নেপু…।