দুদ্দাড় ঢুকে পড়েছে পুলিশের টিম। যে দরজা খুলেছিল, তার বুকে দু’জন অফিসার ঠেকিয়ে দিয়েছেন পিস্তল। সাকুল্যে দুটো ঘর। অগোছালো, নোংরা। একটা ঘরে চাটাই পাতা। তাতে দু’জন ঘুমচ্ছিল। উঠে বসেছে ধড়মড়িয়ে। পাশের ঘরটা তুলনায় বড়। কিন্তু একই রকম অপরিচ্ছন্ন। সেখানে একটা তক্তপোশ। যাতে শুয়েছিল চারজন। হইচই শুনে যাদের ঘুম ভেঙেছে। এবং ভাঙার পর দেখেছে, খেল খতম! প্রতিরোধ করার মতো প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই! ওয়ারলেস বার্তা পেয়ে উল্কাগতিতে চলে এসেছে ধনেখালি থানায় অপেক্ষারত সশস্ত্র টিম। শুরু হয়ে গিয়েছে তল্লাশি।
ওই চৌখুপ্পি সাইজ়ের দুটো ঘরের তল্লাশিতে কতক্ষণই বা সময় লাগে? তক্তপোশের নীচে গোটা চারেক জংধরা ট্রাঙ্ক। যার মধ্যে দুটো থেকে বেরল প্রচুর সোনারুপোর গয়না। যার চেহারা-ছবি মিলে যাচ্ছে বিমল-বর্ণিত খোয়া-যাওয়া গয়নার তালিকার সঙ্গে। আরেকটা ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার হল চারটে শাবল, দুটো বন্দুক, তিনটে ওয়ান শটার আর দুটো নাইন এমএম পিস্তল, যেমনটা মুঙ্গেরে তৈরি হয়।
সাত ডাকাত। বাবুলাল সিং, গণপত রাম, প্রেম পাল, ভগবান সিং, বনওয়ারি সিং, বলবীর সিং, সতীশ গৌতম। সাতজনের মধ্যে সতীশ আর বলবীর ছাড়া সবাই ওই ধানুপুরারই বাসিন্দা। সতীশ আর বলবীর, দু’জনে সম্পর্কে আত্মীয়। দু’জনেরই বাড়ি রাজস্থানে। ধানুপুরা অঞ্চলে সতীশের বোনের বিয়ে হয়েছে। সেই সূত্রে সতীশ-বলবীরের যাতায়াত ধানুপুরায়।
সিজ়ার লিস্ট বানাতে লেগে গেল ঘণ্টাদুয়েক। রাত দশটা নাগাদ যখন ‘সপ্তরথী’-কে প্রিজ়ন ভ্যানে তুলে উত্তর ২৪ পরগনার দিকে রওনা দিচ্ছে পুলিশ, সামনের গাড়িতে গা এলিয়ে দেন সুমনজিৎ। টানা প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে গেল, টিম একরকম নিদ্রাহীনই। অথচ কারও ঘুম পাচ্ছে না। কখন ব্যারাকপুরে পৌঁছনো হবে, কখন শিশুপালকে নিয়ে ফিরবেন প্রবীর, কখন বসা হবে এদের নিয়ে, কখন জানা যাবে ডাকাতিটার আদি থেকে অন্ত, তর সইছিল না যেন। কথায় বলে, দুঃসময় একা আসে না। হয়তো ঠিক। কিন্তু উলটোটাও সত্যি। সুসময়ও একা আসে না। সঙ্গে নিয়ে আসে সাময়িকভাবে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-শ্রান্তি-ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার টোটকা।
ব্যারাকপুর ফিরতে ফিরতে রাত সোয়া বারোটা হয়ে গেল। থানায় তার অনেক আগেই এসে গিয়েছেন এসপি এবং অ্যাডিশনাল এসপি। প্রবীর কাল সকালে ফিরছেন শিশুপালকে ‘ট্র্যানজিট রিমান্ড’-এ নিয়ে।
জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব শেষ হতে হতে রাত কাবার হয়ে গেল প্রায়। ঠিক কীভাবে চিত্রনাট্য রচিত হয়েছিল দুঃসাহসিক ডাকাতির, জানা গেল বিস্তারিত। জানা গেল, একজনকে ধরা বাকি আছে এখনও। ‘দে বাবু’। টিম বেরিয়ে গেল সকালেই। ‘দে বাবু’-কে দুপুরের মধ্যেই তুলে আনা হল হুগলি জেলার হরিপালের বাড়ি থেকে।
কে ‘দে বাবু’? শ্রীকান্ত দে। হরিপালেই যার ছোটখাটো সোনার দোকান আছে। এই শ্রীকান্ত লোকটির মূল ব্যবসাই ছিল চোরাই সোনা কেনাবেচার। ডাকাতির মূল চক্রী ছিল এই শ্রীকান্তই।
হরিপালে শ্রীকান্তের এক প্রতিবেশী ছিল। নাম রামলোচন। আলুর কোল্ড স্টোরেজের কর্মী। উত্তরপ্রদেশের লোক। বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত হরিপালে। রামলোচনের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল শ্রীকান্তের। এই রামলোচন আবার শিশুপালের দেশোয়ালি ভাই। ধানুপুরা গ্রামেই বাড়ি।
মাস সাত-আটেক আগে শিশুপাল আসে রামলোচনের কাছে। আলাপ-পরিচয় হয় শ্রীকান্তের সঙ্গে। চোরে চোরে মাসতুতো-পিসতুতো বা খুড়তুতো ভাই হতে সময় লাগেনি বিশেষ। শিশুপাল নিজেদের গ্যাংয়ের ব্যাপারে সব খুলে বলে শ্রীকান্তকে। বেরিলিতে করা একটা ডাকাতির কিছু সোনা বিক্রির ব্যাপারে আলোচনাও করে। মাসখানেক পরে এসে সেই সোনা বিক্রিও করে যায়। বাড়ে ঘনিষ্ঠতা।
ভবঘুরে-জাতীয় গ্যাং এদের। আট-ন’জনের টিম। বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে বেড়ায়। স্থানীয় যোগাযোগ থাকলে কাজের সুবিধা হয়। মূলত আর্থিক সংস্থার অফিস বা সম্পন্ন সোনার দোকানকেই টার্গেট করত এরা। গত বছরের পুজোর আগে রামলোচনের ভাইঝির বিয়েতে শ্রীকান্ত নিমন্ত্রিত হিসেবে যায় ধানুপুরায়। পরিচয় হয় গণপত-বাবুলাল-বনওয়ারিদের সঙ্গে। শ্রীকান্তকে কথায় কথায় বলেছিল বাবুলাল, ‘বাঙ্গাল মে কোই কামধান্দা হো তো জরুর বাতানা।’
‘কামধান্দা’-র ব্যাপারে বেশি ভাবতে হয়নি শ্রীকান্তকে। তার এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়ি কাঁচড়াপাড়ায়। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত আছে শ্রীকান্তের। বিমলের বাড়ি থেকে বন্ধুর বাড়িটা হাঁটাপথে মিনিট চারেক। বন্ধুরও গয়নার দোকান আছে একটা। বিমলের সঙ্গে খুবই সুসম্পর্ক আছে এই বন্ধুটির। সেই সূত্রেই বন্ধুর সঙ্গে শ্রীকান্ত একাধিকবার গিয়েছেন বিমলের বাড়িতে। ছবির মতো মনে আছে বাড়িটার কোথায় কী।
বিমলের ব্যবসায় যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, দেখে তীব্র হিংসে হত শ্রীকান্তের। বছরদুয়েক আগেও যার কিনা ছোট্ট একরত্তি দোকান ছিল, তার এত বড় শোরুম-ওয়ার্কশপ-চারতলা বাড়ি হয় কোন ভোজবাজিতে? শুধু পরিশ্রম? নাকি অন্য গল্প আছে? হয়তো এ ব্যাটাও চোরাই সোনা কেনে! তার নিজের মতো অল্প টুকটাক নয়, কোনও স্টেডি সাপ্লাই আছে চোরাই মালের। এই বলবন্ত-গণপত-শিশুপালরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ গ্যাং। এদেরকে দিয়ে বিমলের বাড়িতে ডাকাতি করিয়ে দিলে কিছু না হলেও কুড়ি-পঁচিশ লাখের মাল তো পাওয়া যাবেই। তারপর অল্প দামে কিনে নিয়ে ঘষামাজা করে ফের বেচে দেওয়া। লালে লাল হয়ে যাওয়া আটকাতে পারবে না কেউ। হরিপালের দোকানটাকে বড় করার ইচ্ছে বহুদিনের। পুঁজিতে কুলোচ্ছে না। বলবীররা যদি কাজটা করতে পারে, তা হলে আর…।