সুমনজিৎ গলা চড়ান এবার, ‘এভাবে বলব না তো কীভাবে বলব? বলছেন ভুল করে হয়তো হয়ে গেছে? মজা পেয়ে গেছেন? একাধিকবার যখন এমন গুরুতর ভুল হয়েছে, ধরে নিতে হবে, সেটা ইচ্ছাকৃতই।’
রাহুলের ডিফেন্স এবার আরও নড়বড়ে দেখায়, ‘বিশ্বাস করুন স্যার…’
—থানায় চলুন তো আগে… বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফয়সালা না হয় ওখানেই হবে।
ধনেখালি থানায় যখন রাহুলকে নিয়ে পৌঁছল পুলিশ, বেলা গড়িয়ে গেছে অনেকটা। মাঝবৈশাখের রোদ তার তেজ হারিয়েছে। বিকেল ক্রমে সন্ধ্যাকালীন।
পুলিশের গাড়িতে ওঠার পর থেকেই ঘামছিলেন রাহুল। ধনেখালি থানার বড়বাবুর ঘরে ঢুকে যখন একঝাঁক পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি বসানো হল, সুমনজিৎ বুঝতে পারলেন, দম ফুরিয়ে এসেছে রাহুলের। হাত কাঁপছে সামান্য। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছেন ঘনঘন।
স্বীকারোক্তি এল দ্রুতই। সিম কিনতে গেলে যে যে প্রামাণ্য নথি বা ‘ডকুমেন্টস’ প্রয়োজন, অনেকেরই থাকে না। যাদের ডকুমেন্টস নেই, অথচ সিম চাই, তাদের ডবল দামে সিমকার্ড বেচত রাহুল। কী ভাবে? সিম কিনতে গেলে ‘কাস্টমার অ্যাপলিকেশন ফর্ম’ (ক্যাফ) ভরতি করতে হয় গ্রাহককে। নিজের পরিচয় সংক্ৰান্ত প্রামাণ্য তথ্যসমেত। কেউ পাসপোর্টের জেরক্স কপি দেয়, কেউ ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, কেউ-বা অন্য কিছু। সিম-বিক্রেতা দোকান বা এজেন্সিকে সেই ফর্ম পাঠাতে হয় সংশ্লিষ্ট মোবাইল পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থাকে।
যে গ্রাহকরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিয়ে সিম কিনতেন, তাঁদের নথির জেরক্স করে রাখতেন রাহুল। এবং যখন কেউ এসে বলত, সিম লাগবে, কিন্তু ডকুমেন্টস নেই, তখন ওই গ্রাহকদের জেরক্স করা নথি ব্যবহার করতেন। ডকুমেন্ট-হীন ক্রেতাকে আশ্বস্ত করতেন, ‘পেপার্স জোগাড় হয়ে যাবে, তবে টাকাটা ডাবল লাগবে।’
রাহুল জেরায় খোলাখুলি আরও বললেন, ‘এমনটা শুধু আমি নয়, অনেক এজেন্সি করছে স্যার… দেখুন একটু খোঁজ নিয়ে।’
অন্যরা কে কী করছে, সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার সময় পড়ে আছে অনেক। বোঝাই যাচ্ছে, একটা চক্র তৈরি হয়েছে উদোর নথিপত্র নিয়ে বুধোকে সিম দেওয়ার। সুমনজিৎ ভাবছিলেন, সমস্ত মোবাইল পরিষেবা সংস্থার সঙ্গে একটা মিটিং করা দরকার শীঘ্রই। সার্ভিস প্রোভাইডাররা হয়তো জানেই না এই নয়া জালিয়াতির ব্যাপারে, সেভাবে হয়তো এখনও কোনও সিস্টেমই তৈরি হয়নি এটা প্রতিহত করার। কিন্তু এসব তো পরে। আপাতত যেটা জানা দরকার, অনিন্দ্য-সুকান্তের নথি ব্যবহার করে ওই দুটো সিম রাহুল বেচেছিলেন কাদের?
কাদের বেচেছিলেন, দিব্যি মনে ছিল রাহুলের। দু’জন হিন্দিভাষী লোক। রাহুল মুখ চিনতেন। ধনেখালির দশঘরায় রাহুলের বাড়ি। বাড়ির কাছেই সাত-আটজন লোক তিন-চার মাস হল একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। বাড়িটা স্থানীয় একটা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের। যাঁর পাশাপাশি দুটো বাড়ি। একটা দোতলা, যেটায় নিজে থাকেন সপরিবারে। আরেকটা একতলা। যেটা ভাড়া দিয়ে আসছেন বহুদিন ধরেই। পাড়ার লোক জানত, ওই সাত-আটজন হিন্দিভাষী ভাড়াটে উত্তর ভারতের লোক। এ রাজ্যে ব্যবসার কাজে এসেছে। নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত করতে হয়। ঠিক কিসের ব্যবসা, স্থানীয় মানুষ জানত না। জানার আগ্রহও বিশেষ ছিল না। ওই সাত-আটজনের মধ্যেই দু’জন মাসতিনেক আগে রাহুলের দোকানে এসেছিল। বলেছিল, লোকাল সিম দরকার, কিন্তু ডকুমেন্ট নেই। এমন খদ্দেরদেরই অপেক্ষায় থাকতেন রাহুল। অনিন্দ্য-সুকান্তের নথির জেরক্স কপি ব্যবহার করে ডবল দামে বেচে দেন সিম। ওঁদের নামেই রেজিস্টার্ড হয়ে যায় সিম-নম্বর।
—নাম জানেন ওই দু’জনের?
—না স্যার, তা কী করে জানব? ওই একবারই দু’জনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, যেদিন দোকানে এসেছিল। তারপর এক-দু’বার বাজারে দেখেছি। কথা হয়নি।
—বাড়িটা তো চেনেন বললেন…
—হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, চিনি না আবার! একদম চিনি।
—এখন তো সন্ধে হয়ে গেছে। এখন গেলে পাওয়া যেতে পারে ওদের?
প্রাথমিক ভয় আর জড়তা কেটে গিয়ে রাহুল তখন প্রায় সোর্সের ভূমিকায়, আমাকে দুটো ফোন করতে দিন স্যার। আমি জেনে নিচ্ছি, এখন ওরা আছে কি না।
ফোন করতে দেওয়া হল রাহুলকে। পালটা ফোন এল মিনিট পনেরোর মধ্যেই। হ্যাঁ, এখন ওই বাড়িতেই আছে ওরা। ফোনে এসপি-কে পুরোটা জানালেন সুমনজিৎ। সবুজ সংকেত এল রেইডের। রাহুলের সঙ্গে গিয়ে বাড়িটা ‘রেকি’ করে আসা হল। পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল।
জনবহুল মহল্লার মধ্যেই বাড়ি। ঢোকা-বেরনোর একটাই দরজা। ধনেখালি থানায় একটা সশস্ত্র বাহিনী তৈরি রইল। যারা ফোনে বা ওয়ারলেসে বার্তা পেলেই ছুটবে ওই বাড়িতে। মূল ‘রেইড’-এ থাকবে সুমনজিতের নেতৃত্বে সাদা পোশাকের টিম। সঙ্গে ধনেখালি থানার ওসি এবং তাঁর টিমের ছ’জন। সবাই প্লেন ড্রেসে। প্রত্যেকের কোমরে গোঁজা নাইন এমএম পিস্তল। লোডেড। যাদের খোঁজে যাওয়া, তারা বেপরোয়া প্রকৃতির ডাকাত। সামান্যতম বিপদের আঁচ পেলে যে-কোনও মুহূর্তে গুলি চালাতেই পারে। বারবার ‘ব্রিফ’ করে দেওয়া হল সবাইকে। চূড়ান্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
সতর্কতার তেমন প্রয়োজনই হল না অবশ্য। ধনেখালির ওসি কড়া নাড়লেন দরজায়। খুলল এক মাঝবয়সি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঘুমচোখ। এবং দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নাকে যে তীব্র গন্ধটা ছিটকে এল, তাতেই সুমনজিৎ বুঝলেন, ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন। এ গন্ধ ভোলার নয়! এ সেই ‘হিমতাজ’ তেলের বিকট গন্ধ! যে তেলের শিশি বিমলের বাড়ির ফ্রিজের উপর ফেলে গিয়েছিল ডাকাতরা। ওই টেনশনের মধ্যেও ক্ষণিকের জন্য ছোটবেলায় পড়া ওই গল্পটা মনে পড়ে গিয়েছিল সুমনজিতের। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জাদুকরী কলমে লেখা। ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’!