বিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখছিল না পুলিশ। ইয়ারকি নাকি? বললেই হল, আর ফোন নেই? যে নম্বরের সঙ্গে শিশুপালের কথা হচ্ছে, তার ‘কাস্টমার অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম’ আগেই জোগাড় করা হয়েছে সার্ভিস প্রোভাইডারের থেকে। সেই ফর্মে সুকান্তের ভোটার আইডেন্টিটি কার্ডের ছবি জ্বলজ্বল করছে। এখন বললেই হল, নেই? নেই, তো গেল কোথায়? থানায় এনে একটু ‘যত্নআত্তি’ করার উপক্রম করলেই দ্বিতীয় মোবাইল সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে, নিশ্চিত ছিলেন সুমনজিৎরা।
নিশ্চিত থাকা কিন্তু গেল না জামালপুর থানায় সুকান্তকে নিয়ে এসে ঘণ্টাদেড়েক ধরে নানা কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদের পর। সুকান্ত অবিচল থাকলেন নিজের বয়ানে, ‘আমাকে মেরে ফেললেও একই কথা বলব স্যার, যে নম্বরের কথা আপনারা বলছেন, ওই নম্বরের কোনও মোবাইল আমার নেই। আমার এই একটাই ফোন।’ সুমনজিৎ এবং টিমের অন্যদেরও খটকা লাগতে শুরু করল এবার। প্রতিকূল পরিবেশে প্রবল পুলিশি চাপ সহ্য করে নিজের নির্দোষিতার ব্যাপারে এতটা আত্মবিশ্বাসী থাকাটা একজন অপরাধীর পক্ষে বেশ অস্বাভাবিকই। কোথাও গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে বড়সড়! নতুন করে ফের ভাবা দরকার ঠান্ডা মাথায়।
ভাবা হল। সুকান্তের কাছে যে মোবাইলটা ছিল, সেটার টাওয়ার লোকেশন দেখা হল। ডাকাতির আগে বা পরে কাঁচড়াপাড়ার ত্রিসীমানাতেও ছিল না। ফোনের অবস্থান ছিল জামালপুরেই। এবং সুকান্তের এই ফোনের থেকে শিশুপালের নম্বরের কোনও যোগাযোগ হয়নি কখনও। শুধু তাই নয়, সুকান্তর কাছে পাওয়া ফোনের থেকে কখনও কোনও যোগাযোগ হয়নি ওই সন্দেহজনক নম্বরেরও, যে নম্বরে শিশুপাল নিয়মিত কথা বলেছে, যে নম্বরের ফোন সুকান্তের কাছে পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত ছিল পুলিশ। এসবের একটাই মানে দাঁড়ায়। সুকান্ত সম্ভবত মিথ্যে বলছেন না। সত্যিই তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই এ ডাকাতির সঙ্গে।
সুকান্ত যে ফোনটা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন, তার ‘ক্যাফ’ আনানো হল পরদিন সকালে। এখানেও প্রত্যাশিতভাবেই সুকান্তের ছবি। ‘ভুতুড়ে’ সিমকার্ডের ‘ক্যাফ’-এ যে ছবি ছিল সুকান্তের, সেই একই ভোটার আইডি কার্ডের ছবি। দুটো সিমকার্ডের ‘ক্যাফ’ পাশাপাশি রেখে দেখা হল খুঁটিয়ে। এবং দেখতে গিয়েই চমক! যে দোকান বা এজেন্সি থেকে সিম বিক্রি হয়, নথিপত্রে ‘সিল’ থাকে সেই দোকানের। এ তো দেখা যাচ্ছে, দুটো সিমই বিক্রি হয়েছে একই দোকান থেকে। নেহাতই সমাপতন?
সুমনজিতের হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, ওই অনিন্দ্যের সঙ্গে যে নম্বরে শিশুপাল কথা বলছিল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, তার ‘ক্যাফ’-টাও তো জোগাড় করা ছিল। ওটা দেখা যাক একবার। দেখা হল। আরে! এ কী! এই সিমকার্ডও বিক্রি হয়েছে ধনেখালির ওই এজেন্সি থেকেই। এটাও সমাপতন? হতেই পারে না! ইম্পসিবল!
দুটো সন্দেহজনক নম্বর, দুটো সন্দেহজনক সিম। যাদের নামে নথিভুক্ত, তাদের একজন সুকান্ত। যিনি বলছেন, তাঁর কাছে এমন কোনও সিমই নেই। অন্যজন, অনিন্দ্যকে নিয়ে আসা হল থানায়। এবং যেমনটা আঁচ করতে শুরু করেছিলেন অফিসাররা, সেটাই ঘটল। অনিন্দ্য সেলস রিপ্রেজ়েন্টেটিভের কাজ করেন। আকাশ থেকে পড়লেন সব শুনে। যে সিম বিক্রি হয়েছে তাঁর ছবি এবং অন্যান্য নথিপত্রের ভিত্তিতে, এমন সিম নেই-ই তাঁর কাছে। একটাই মোবাইল তাঁরও। অনিন্দ্যর কল ডিটেলস এবং টাওয়ার লোকেশন পরীক্ষা করেও দূরতম আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া গেল না তাঁর এই ডাকাতিতে জড়িত থাকার।
মোদ্দা ব্যাপারটা কী দাঁড়াল তা হলে? একই দোকান থেকে দুটো সিম কার্ড বিক্রি হয়েছে এমন দু’জনের নথি ব্যবহার করে, যাঁরা সেই সিম কেনেনই নি। নথি স্বাভাবিক নিয়মে দোকানির কাছেই ছিল। কারণ, অনিন্দ্য-সুকান্ত দু’জনেই ওই দোকান থেকে সিম কিনেছিলেন, যেগুলো এখন নিজেরা ব্যবহার করেন। সাপ্লাইয়ের কাজে সুকান্তকে প্রায়ই ধনেখালি যেতে হয়। আর অনিন্দ্যর শ্বশুরবাড়ি ধনেখালিতে। দু’জনেই ঘটনাচক্রে সিম কিনেছিলেন ওই দোকান থেকেই।
দোকানের কোনও কর্মচারীর এই জাতীয় অসাবধানতাজনিত ভুল? একবার নয়, দু’-দু’বার? হয় কখনও? এখন প্রশ্ন, কাদের কাছে বিক্রি হয়েছে ওই দুই সন্দেহজনক সিম? উত্তর যেখানে লুকিয়ে আছে, দুপুর গড়ানোর আগেই সেখানে রওনা দিল টিম।। ধনেখালি।
ছোটখাটো এজেন্সি ধনেখালি বাজারের কাছে। মালিকের নাম রাহুল। বয়স ওই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের মধ্যে। সুমনজিৎ সরাসরি দুটো সন্দেহজনক সিমকার্ডের নথি সামনে রাখলেন রাহুলের, ‘এগুলো আপনার দোকান থেকে বিক্রি হয়েছে । কিন্তু যাঁদের নথি ব্যবহার করে বিক্রি হয়েছে, তঁাদের ফোনে এই সিম নেই। এটা কী করে হল?’
রাহুলের চোখেমুখে বিস্ময়ের আঁকিবুকি, ‘এমন তো হওয়ার কথা নয় স্যার!’
—সে তো আমরাও জানি, হওয়ার কথা নয়। সেজন্যই তো জানতে চাইছি। সেজন্যই তো আসা।
—বুঝলাম স্যার। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমনটা হয়নি কখনও আমার দোকানে…
—‘আজ পর্যন্ত’ তো আজকেই শেষ রাহুলবাবু… কালকে কী হবে সে আর কে জানে বলুন…ঘটনাটা আপনার দোকান থেকেই ঘটেছে… জবাবটাও ন্যাচারালি আপনাকেই দিতে হবে।
রাহুলকে সামান্য নার্ভাস দেখায় এবার, ‘এভাবে বলছেন কেন স্যার? কত সিম বিক্রি হয় দোকান থেকে… কর্মচারীরা সবসময় ডকুমেন্টস চেক করে নেয়। হয়তো ভুল করে…’