টিম রওনা হল ১৯ এপ্রিল। তার আগে পুলিশ সুপার ফোনে আলোচনা করে নিলেন বাদাউনের এসপি-র সঙ্গে। যিনি স্পষ্ট জানালেন, যে অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট নম্বরের বর্তমান অবস্থান, সেই ধানুপুরা গ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে পরিচিত। দাগি ক্রিমিনাল-অধ্যুষিত। ওখানে ‘রেইড’ করতে গেলে স্থানীয় পুলিশও রাজ্যের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর সাহায্য নেয়। এই অভিযানেও ইউপি পুলিশের এসটিএফ-এর প্রয়োজন পড়বে। প্রাথমিক হোমওয়ার্ক পুলিশ সেরেই রাখবে, আশ্বস্ত করলেন এসপি।
হোমওয়ার্ক যে বাস্তবিকই অনেকটাই সেরে রেখেছে জেলা পুলিশ, বাদাউন পৌঁছে এসপি-র সঙ্গে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলেন প্রবীর। এসপি শুরুতেই বললেন, ‘যাকে ধরতে এসেছেন, তার নাম বাদাম সিং নয়। বাদাম সিং-ও ডাকাত, দাগি আসামি। কিন্তু এখন জেলে আছে। ওর নাম ব্যবহার করে সিমটা নেওয়া হয়েছে। যে নিয়েছে, তার নাম শিশুপাল। এরও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। গ্রেফতারও হয়েছে আগে বেশ কয়েকবার। ডাকাতির কেসেই। ছবিও আছে আমাদের রেকর্ডে। ধানুপুরা গ্রামে বাড়ি। এখান থেকে একুশ কিলোমিটার দূরে। আমাদের জেলার বর্ডার। ওই গ্রামের পরেই অন্য জেলার এলাকা শুরু। কাঁসিরাম নগর। ট্রাস্ট মি, ধানুপুরা ইজ় আ নটোরিয়াস ভিলেজ। একশো পুলিশ নিয়ে রেইড করলেও ওখান থেকে কাউকে ধরা একটু মুশকিলই। ছোট গ্রাম। হাজার দুয়েক লোক। পুলিশ হোক বা অন্য কেউ, বাইরের কেউ ঢুকলেই ‘‘খবর’’ হয়ে যায়। ওভাবে ধরা যাবে না শিশুপালকে।’
—তা হলে?
এসপি আশ্বস্ত করলেন, ‘গ্রামের বাইরে এলে ধরতে হবে। আগে বের করতে হবে গ্রাম থেকে। আমাদের এসটিএফ-এর অফিসাররা লেগে আছেন। শিশুপালের সঙ্গে একসময় খুচরো চুরি-ছিনতাই করেছে, এমন সোর্স লাগানো হয়েছে। সেই সোর্সকে দিয়ে আজ রাতে গ্রামের বাইরে একটা মদের ঠেকে ডেকে পাঠানোর প্ল্যান আছে। সোর্সের সঙ্গে কথাও হয়েছে শিশুপালের। পেয়ে যাবেন রাতের মধ্যেই, সব যদি ঠিকঠাক থাকে।’
সব ঠিকঠাকই থাকল। ধানুপুরা থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে ভোজপুর-নারায়ণপুর গ্রাম। সেখানে রাত আটটা নাগাদ সাইকেলে করে শিশুপালের আবির্ভাব ঘটল। সোর্সকে নিয়ে সন্ধে ছ’টা থেকেই ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল বাদাউন জেলা পুলিশের টিম, এসটিএফ-এর অফিসাররা এবং সদলবলে প্রবীর। ‘শিশুপাল-বধ’ সম্পন্ন হল অনায়াসে। পকেট থেকে উদ্ধার হল চন্দনাদেবীর মোবাইল। ধন্দের আর জায়গা নেই কোনও। শিয়োর শট ডিটেকশন। ঘটনার ঠিক দু’মাস পর, এপ্রিলের একুশে। উচ্ছ্বসিত প্রবীর ফোন করলেন পুলিশ সুপারকে, ‘স্যার! মিশন সাকসেসফুল!’
‘মিশন’ আসলে শুরু হয়েছিল সবে। শিশুপালকে পেলেই তো শুধু হল না। প্ল্যানমাফিক রাতেই তুলতে হবে সম্ভাব্য দুই শাগরেদ অনিন্দ্য-সুকান্তকে। ঠিক হল, প্রথমে সুকান্তকে তোলা হবে জামালপুর থেকে। অনিন্দ্যর বাড়িতে তারপর হানা দেওয়া হবে সুকান্তকে সঙ্গে নিয়েই। রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে সুমনজিতের নেতৃত্বে জামালপুর পৌঁছে গেল উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের টিম। সুমনজিতের সঙ্গী হলেন আইসি জগদ্দল সুবীর চ্যাটার্জি সহ ‘সিট’-এর বাছাই করা কয়েকজন কর্মী-অফিসার।
সুকান্তকে পাওয়া গেল বাড়িতেই। বছর তিরিশের যুবক। নেহাতই সাদামাটা চেহারা। মধ্যবিত্ত সংসার। মা-বাবার একমাত্র ছেলে। ঘুমনোর তোড়জোড় করছিলেন। পুলিশের টিম দেখে ভীষণই ঘাবড়ে গেলেন। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কথাবার্তার আওয়াজে ওঁদেরও ঘুম ভেঙে গেল এবং ঘরে পুলিশ দেখে দৃশ্যতই আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
সুমনজিৎ প্রথম প্রশ্নটাই করলেন, ‘আপনার ক’টা মোবাইল?’
—একটাই স্যার।
—মোবাইলটা কোথায়?
শোয়ার ঘরে চার্জে বসানো ছিল ফোনটা। বিনা বাক্যব্যয়ে সুকান্ত মোবাইল তুলে দিলেন সুমনজিতের হাতে।
—হ্যাঁ, নম্বরটা বলুন ফোনের।
সুকান্ত বললেন নম্বর। যাতে ‘কল’ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাচাই করেও নেওয়া হল, ঠিক বলছেন কিনা। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! এই নম্বর তো মিলছে না সেই নম্বরের সঙ্গে, যে নম্বরে দিনে অন্তত আটবার করে কথা বলেছে শিশুপাল গত দেড়মাস ধরে। মিলছে না তো! সুমনজিৎ ফের চেপে ধরেন সুকান্তকে।
—আর ক’টা ফোন আছে আপনার?
—এই একটাই স্যার।
—দেখুন সুকান্তবাবু, কোনও জোরজবরদস্তি করতে চাই না। অন্য ফোনটা দিন।
—বিশ্বাস করুন স্যার, আমার এই একটাই ফোন।
—কী করেন আপনি?
—বিশেষ কিছু না স্যার, টুকটাক সাপ্লাইয়ের কাজ।
—শিশুপাল বলে কাউকে চেনেন?
—না স্যার।
সুমনজিৎ তাকান সুবীরের দিকে, ‘এভাবে হবে না। একে থানায় নিয়ে গিয়ে কথা বলতে হবে। তার আগে ঘরটা ভাল করে সার্চ করা দরকার।’ তল্লাশি হল তন্নতন্ন করে। না পাওয়া গেল দ্বিতীয় কোনও মোবাইল, না পাওয়া গেল কোনওরকম অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত থাকার প্রমাণ। যখন তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসছে পুলিশ, মা কান্নাকাটি জুড়েছেন, বাবা দাঁড়িয়ে আছেন স্তব্ধবাক, তখনও সুকান্ত চিৎকার করে যাচ্ছেন, ‘আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? সামান্য সাপ্লাইয়ের কাজ করে খাই। জীবনে কখনও কোনও দু’নম্বরি কাজে জড়াইনি, বিশ্বাস করুন। মাক্কালীর দিব্যি স্যার…বিশ্বাস করুন!’