সেটা কী?
ধরুন আপনি ওই মডেলের ফোন কিনলেন। এবং ফোনটা চুরি হয়ে গেল। এখন চুরি যাওয়া ফোনে যে মুহূর্তে চোর অন্য সিম ভরে চালু করবে, ‘মোবাইল ট্র্যাকার টেকনোলজি’র সৌজন্যে একটা এসএমএস আসবে এমন একটা পূর্বনির্ধারিত নম্বরে, কেনার সময় যে নম্বরটা আপনার ফোন-মেমরিতে ভরে দেওয়া হয়েছিল। এসএমএসে অটোম্যাটিকালি বার্তা আসবে মেমরিতে ভরে রাখা টেমপ্লেটের—‘প্লিজ় হেল্প মি, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার’। যে নতুন সিম ভরা হয়েছে চুরি যাওয়া ফোনে, তার নম্বর তো বটেই, সিমের আইইএমআই নম্বরও জানা যাবে এসএমএস মারফত। এবার পুলিশকে জানালে টাওয়ার লোকেশন দিয়ে সহজেই ট্র্যাক করা যাবে ফোনের অবস্থান।
এই পূর্বনির্ধারিত নম্বরটা কী হবে, সেটা আপনি অর্থাৎ খদ্দের ঠিক করে দেবেন ফোনটা কেনার সময়। খদ্দের স্বাভাবিকভাবেই নিজের পরিচিত কারও নম্বরই ঢোকাবেন মেমরিতে। বিমল যখন ফোনটা কিনেছিলেন, দোকানের মালিক সোৎসাহে বুঝিয়েছিলেন এই প্রযুক্তির কথা। জানতে চেয়েছিলেন, পূর্বনির্ধারিত কোন নম্বরটা বিমল মেমরিতে ঢোকাতে চান। বিমলের প্রযুক্তি বিষয়ক ধ্যানধারণা অতি সীমিত, বোঝেনওনি পুরো ব্যাপারটা। বলেছিলেন, ‘আপনিও তো পাড়ারই লোক… আমার অনেকদিনের পরিচিত… আপনার নম্বরটাই ভরে দিন না হয়।’ দোকানি সেটাই করেছিলেন। আজ দুপুরে চন্দনার ফোন থেকে ওই টেমপ্লেট-মেসেজ ঢুকেছে তাঁর ফোনে। দোকানি ভদ্রলোক নিমেষে বুঝেছেন, লুঠ হওয়া মোবাইল চালু করা হয়েছে অন্য সিম ভরে। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছেন বিমলকে। পরামর্শ দিয়েছেন একটুও দেরি না করে পুলিশকে জানাতে। জানামাত্রই বীজপুর থানার পুলিশ একরকম তুলেই নিয়ে গেছে দোকানদারকে। এই হল গল্প।
ঝটিতি ‘সিট’-এর সদস্যদের নিয়ে বসলেন পুলিশ সুপার। কিনারা-সূত্রের আভাসে রাতারাতিই যেন চাঙ্গা হয়ে গেছে টিম। অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ ধরা পড়ছে সুমনজিৎ-প্রবীরদের নড়াচড়ায়।
যে সিমটা ভরা হয়েছে ফোনে, সেটার ‘সাবস্ক্রাইবার ডিটেলস’ নেওয়া হল দ্রুত। সিমটা বাদাম সিং বলে একজনের নামে। ঠিকানা? পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাদাউন জেলা। এর বেশি নির্দিষ্ট তথ্য নেই সার্ভিস প্রোভাইডারের নথিতে। ফোনের অবস্থান? বাদাউন জেলারই ‘কাদের চক’ ব্লকের ধানুপুরা গ্রামের কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে।
বেশ, এবার পরের ধাপ। সিমটা আজই চন্দনার ফোনে ভরেছে। নিজের মোবাইলে তো নিশ্চয়ই এই সিমই ব্যবহার করত এতদিন। এই সিম-নম্বরের কল ডিটেলস রেকর্ড নেওয়া যাক তা হলে। নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে ভিনরাজ্যের সঙ্গীসাথীদের নাম।
বেরল না ভিনরাজ্যের সম্ভাব্য দুষ্কৃতীদের নাম। কল রেকর্ডসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বরং চিহ্নিত করা হল এ রাজ্যেরই দু’জনকে। যাদের সঙ্গে সম্প্রতি রোজই ঘনঘন কথা বলেছে বাদাম সিং। একজনের নাম অনিন্দ্য ঘোষ। খড়দায় বাড়ি। দ্বিতীয়, সুকান্ত রুইদাস। বাড়ি, বর্ধমানের জামালপুর। সার্ভিস প্রোভাইডার সংস্থার থেকে জোগাড় করা হল দু’জনের সিমকার্ড-সংক্রান্ত নথিপত্র। আরও সহজ করে বললে, ‘Customer Application Form’ বা ‘ক্যাফ’।
দিনে অন্তত সাত-আটবার করে খড়দা আর জামালপুরের এই দু’জনের সঙ্গে কিসের এত কথা বাদাম সিংয়ের? সেই বাদাম সিংয়ের, যার কাছে চন্দনার ফোনটা আছে এবং সুতরাং ডাকাতি আর খুনের সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত? অনিন্দ্য-সুকান্তই কি ‘লোকাল কনট্যাক্ট’? স্থানীয় গ্যাংয়ের সদস্য, যারা যুক্ত ছিল ঘটনায়? সূর্য গোলদারদের গ্যাং নয়? ‘বাদাম সিং’ আদৌ ঠিক নাম কিনা জানা নেই। এমনও হতে পারে, অন্য নামে কেউ ওই সিম ব্যবহার করছে।
সে যা-ই হোক, সিদ্ধান্ত হল, এই ‘বাদাম সিং’-কে তো তুলতে হবেই। তবে মোটামুটি একই সময়ে এই অনিন্দ্য-সুকান্তকেও আটক করতে হবে জেরার জন্য। গ্যাং বারো-চোদ্দো জনের। সূর্য গোলদার সহ ছ’জন এই ঘটনায় জড়িত কিনা, নিশ্চিত নয় এখনও। যদি ধরে নেওয়া যায় যে ওই ছ’জন যুক্ত ছিল, তা হলেও বাকি থাকে আরও ছয় থেকে আটজন। সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তিন সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের। বাদাম সিং, অনিন্দ্য ঘোষ আর সুকান্ত রুইদাস। এদের মোটামুটি একই সময়ে তুলতে হবে। আগে-পরে হলে মুশকিল। ‘খবর’ হয়ে যাবে। ফোনে রোজ অনেকবার কথা হয় তিনজনের মধ্যে। আরও একাধিকের হয়তো ফোন-যোগাযোগ আছে এদের সঙ্গে। ফোনে না হলেও হয়তো অন্যভাবে আছে। পুরো নেটওয়ার্কটা এখনও স্পষ্ট নয়। বাদাউন থেকে বাদাম সিং গ্রেফতার হয়েছে, এই খবর হয়তো দ্রুতই পৌঁছবে অনিন্দ্য-সুকান্তর কাছে। সতর্ক হয়ে যাবে। গা-ঢাকা দেবে। আবার উলটোটাও সত্যি। অনিন্দ্যরা এখানে আটক হলে খবর হয়তো সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাবে বাদাউনে। চম্পট দেবে বাদাম সিং।
তা হলে করণীয়? অনিন্দ্য-সুকান্তের ঘরবাড়ি চিহ্নিত করে রাখা হল। চালু হল নজরদারিও। ওদের তোলা যাবে যখন-তখন। আগে বাদাম সিংকে ধরতে হবে। সেটা তুলনায় ঢের বেশি কঠিন কাজ। যেটা সম্পন্ন হলে কালবিলম্ব না করে অনিন্দ্য-সুকান্তের বাড়িতে হানা দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হল, একটা টিম রওনা দেবে বাদাউনে। প্রবীর থাকলেন নেতৃত্বে। সঙ্গে জেলার আরও জনাপাঁচেক অফিসার-কনস্টেবল। সিআইডি সরকারি ভাবে কেসের দায়িত্ব নেয়নি ঠিকই, কিন্তু সহায়ক-শক্তি হিসেবে সক্রিয় ছিল শুরু থেকেই। প্রবীরের সঙ্গী হলেন সিআইডি-র কয়েকজন অভিজ্ঞ অফিসার।