ছ’জনের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন নেওয়া হল সে-রাতের। আশ্চর্য, কাঁচড়াপাড়ার ধারেকাছেও নেই কারও ফোনের অবস্থান! ২০ ফেব্রুয়ারির রাত থেকে ২১ ফেব্রুয়ারির ভোর পর্যন্ত সবার ফোনের লোকেশন ওই নিউ ব্যারাকপুর-ঘোলার আশেপাশেই।
সূর্য আর বাবর আলির বাড়ি নদিয়ার হরিণঘাটায়। ঘোলা থানার সাজিরহাটে বাকি চারজনের। ছ’জনকেই পুলিশি হেফাজতে নিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হল। কিন্তু ফিরতে হল শূন্য হাতেই। ‘রিকভারি’ নেই। স্বীকারোক্তিও নেই। পুলিশ কাস্টডির মেয়াদশেষে সূর্যদের ঠাঁই হল জেলে, এই কেসে গ্রেফতার হওয়া সন্দেহভাজন হিসেবে।
চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির কেসে সমাধানের মূল কথাই হল ‘ফলেন পরিচয়তে’। মোদ্দা কথা, ধৃতদের কাছ থেকে চুরি-ছিনতাই হওয়া জিনিস উদ্ধার হলে তবেই নিশ্চিত হওয়া যায়, হ্যাঁ, কাজটা এরাই করেছে। ‘রিকভারি’ না হলে দাঁড়ায়ই না মামলা, সে যতই সন্দেহের কারণ থাকুক।
ঠিক সেটাই ঘটছিল সূর্যদের গ্রেফতারি নিয়েও। ওই চামড়ার বেল্ট উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ধরে নিয়েছিল, গ্যাং চিহ্নিতকরণের কাজটা হয়ে গেছে। এবার স্বীকারোক্তি আদায়, বাকিদের জালে তোলা এবং লুঠের মাল উদ্ধার স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বেল্ট উদ্ধারের খবর ফলাও করে প্রচার হয়েছিল মিডিয়াতেও, ‘চন্দনা হত্যাকাণ্ডে ধৃত ছয়, উদ্ধার সেই বেল্ট’। কিন্তু মালপত্র কিছুই উদ্ধার না হওয়ায় সাধারণ মানুষ তো বটেই, পুলিশও ধন্দে পড়ে যাচ্ছিল। তা হলে কি এরা সত্যিই যুক্ত ছিল না? ভুল লোককে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এই কেসে?
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল। ঘুরে যাচ্ছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। সূর্য গোলদারদের গ্রেফতারির পর তদন্তের অগ্রগতি একরকম থমকে গিয়েছিল বললেই চলে। ‘রেইড’ হচ্ছিল বটে এদিক-সেদিক। সোর্সরা যে যখন যা খবর দিচ্ছিল, যাচাই করা হচ্ছিল প্রত্যেকটাই। কিন্তু ‘লিড’ আর পাওয়া যাচ্ছিল কই?
এই ‘কিছুতেই কিছু হচ্ছে না’-র সময়টায় যখন পুলিশ সুপার বিশেষ তদন্তকারী দলের কাজকর্মের পর্যালোচনা-বৈঠকে বসতেন, বুঝতে পারতেন, হতাশার ভাইরাসে ক্রমে আক্রান্ত হচ্ছে টিম। এবং একটাই কথা আউড়ে যেতেন নিয়মিত, ‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে। সবাই শুনেছ তোমরা। Fortune favours the brave. ভাগ্য বীরেরই সহায় হয়। পুলিশি তদন্তের ক্ষেত্রে কিন্তু ‘fortune favours the perseverant.’
কথাটা নতুন নয়। জানাই আছে, জটিল মামলার তদন্তে ভাগ্য তাদেরই সহায় হয় যারা ধৈর্যের ফিক্সড ডিপোজ়িটে হাত দেয় না চরম সংকটেও। শুনতে শুনতে এক একসময় সুমনজিতের মনে হত, এসপি নেহাতই ‘ভোকাল টনিক’ দিচ্ছেন টিমের মনোবল অটুট রাখতে। আবার কখনও মনে হত, ভুল তো কিছু বলছেন না। মনে পড়ত কবীর সুমনের ‘তিন তালের গান’-এর সেই লাইনটা, ‘কখন কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না!’ পরক্ষণেই আবার ভাবতেন, মাসদেড়েক হয়ে গেল ঘটনার পর। আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটছে আর কোথায়? ঘটবে আদৌ?
ঘটল। ভাগ্য সহায় হল এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের বিকেলে। যখন সুমনজিৎ রোজকার ফাইলে চোখ বুলোচ্ছেন অফিসে বসে। সাধারণত মোবাইল ভাইব্রেশন মোডে রাখেন। ফাইলে সই করতে করতেই টেবিলে রাখা ফোনে কম্পন টের পেলেন। চোখ রাখলেন স্ক্রিনে। ‘আইসি বীজপুর কলিং’।
—হ্যাঁ, প্রবীর?
এত উচ্চগ্রামে প্রবীর কথা শুরু করলেন, ফোন রেখে দিয়ে ‘হ্যালো’ বললেও বোধহয় শোনা যেত বীজপুর থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত।
—স্যার, একবার থানায় আসবেন?
—এখন? কেন, কী হল হঠাৎ?
—যে ফোনটা ডাকাতরা নিয়ে গেছিল, মানে চন্দনাদেবীর ফোনটা, সেটা বোধহয় অ্যাকটিভাইজ়ড হয়েছে। যে দোকান থেকে বিমল ফোনটা কিনেছিলেন, তার মালিকের ফোনে একটা অদ্ভুত এসএমএস এসেছে লুঠ হওয়া ফোনটার নম্বর থেকে।’
—কী এসএমএস?
—‘প্লিজ় হেল্প মি, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার’।
—মানে?
—মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না স্যার… হু ইজ় ইন ডেঞ্জার… কী হেল্প চাইছে… দোকানের মালিকের কাছেই বা কেন চাইছে… ভুতুড়ে ব্যাপার স্যার!’
—আসছি এখনই।
—আসুন স্যার… দোকানের মালিককে বসিয়ে রেখেছি।
সুমনজিৎ ছুটলেন বীজপুর থানায়। ফোনের দোকানের মালিক এমন কাঁচুমাচু মুখে বসে আছেন, মনে হবে ডাকাতিটা উনিই করেছেন বা করিয়েছেন। থানায় আসার অভিজ্ঞতা নেই, বেশ বোঝা যাচ্ছে হাবভাবে। তার উপর প্রবীর সহ অন্য অফিসাররা ভদ্রলোকের দিকে ঘনঘন কড়া দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।
দোকানের মালিককে একটু ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলেন সুমনজিৎ। কথা শুরু করলেন তারপর, ‘এই মেসেজটা আপনার ফোনে…চন্দনাদেবীর লুঠ হয়ে যাওয়া ফোন থেকে… কী ব্যাপার বলুন তো?’
ব্যাপারটা যে কী, পরিষ্কার হয়ে গেল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এবং রক্তকণিকায় একশো মিটার স্প্রিন্টের ছটফটানি টের পেলেন সুমনজিৎ। ফোনে তৎক্ষণাৎ ধরলেন এসপি-কে। চেপে রাখতে পারলেন না উচ্ছ্বাস, ‘স্যার! ফাইনালি লিড পাওয়া গেছে একটা। ডেফিনিট লিড!’
কী লিড? কেন ‘ডেফিনিট’?
চন্দনার যে ফোনটা ডাকাতরা নিয়ে গিয়েছিল, সেটা স্যামসাং কোম্পানির। কাঁচড়াপাড়ারই দোকান থেকে কেনা। যে মডেলের ফোন, সেটা ‘লঞ্চ’ হয়েছিল সবে গত বছর, নানান অভিনব ফিচার্স সহ। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপিত ছিল ‘মোবাইল ট্র্যাকার টেকনোলজি’।