শত্রুপক্ষ বলতে? বিমলের ব্যাখ্যা, প্রচুর পরিশ্রমের ফলে তাঁর ব্যবসার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটেছে। চারতলা বাড়ি কিনেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ প্রবল ঈর্ষান্বিত। তারাই রটাচ্ছে যত আজগুবি খবর।
যা রটে, তার কিছু কি বটে? ডাকাতিটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিমল কি জানতেন, ডাকাতিটা হবে? চেয়েছিলেন, ডাকাতিটা হোক? চন্দনাকে তো আঘাত করেও চুপ করিয়ে দেওয়া যেত। ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। বা মুখ বন্ধ করে দেওয়া যেত প্রাণের ভয় দেখিয়ে, যেমন বিমলকে করা হয়েছিল। একেবারে নীচে ছুড়ে ফেলার মতো মরিয়া কাজ ডাকাতরা করতে গেল কেন? সত্যি-মিথ্যে এখনও যাচাই করা যায়নি, তবে বিমলের পরকীয়াজনিত কিছু খবরও বাতাসে ভাসছে। চন্দনার বেঁচে থাকা কি অসুবিধেজনক হয়ে উঠছিল অন্য কোনও সম্পর্কের কারণে?
আর হ্যাঁ, গয়নাগাটি সবই নিয়ে গেছে ডাকাতরা, কিন্তু তাতে আর কতটা ক্ষতি হবে বিমলের? নিজেই তো বলেছেন, ‘ইনশিয়োর’ করা ছিল প্রায় সবটাই। আর একটা খটকা, চন্দনার মোবাইল নিয়ে গেল ডাকাতরা। বিমলেরটা কেন নিয়ে গেল না? অস্বাভাবিক নয়?
বিমল-বিদ্যুৎ বাদে ডাকাতির আর দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী, অভিজিৎ আর নিরঞ্জনের ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যাচ্ছে না। বারবার জেরা করা হয়েছে ওঁদের। বয়ান বারবার ওঁরাও বদলেছেন। আগে-পরের বয়ানে অসংগতির ব্যাখ্যা সেই একই, ‘এত ভয় পেয়ে গেছিলাম যে, সব কিছু ভাল করে খেয়াল করার অবস্থাতেই ছিলাম না। যখন যেমন মনে পড়ছে, তেমনই তো বলছি স্যার।’
নিরঞ্জন লোকটি বিমলের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে আছে। পরিবারের অংশই বলা যেতে পারে। যদি সত্যিই ডাকাতি ঘটানো হয়ে থাকে বিমলের জ্ঞাতসারে, তা হলে নিরঞ্জনেরও পুরো পরিকল্পনার শরিক হওয়াটা স্বাভাবিক। আর অভিজিৎ? তিরিশ বছরের যুবক। তিন বছর হল বিমলের ওয়ার্কশপে কাজ করছেন কারিগর হিসেবে। সেই রাতে সত্যিই কি এতটা কাজের চাপ ছিল, যে বাড়ি না ফিরে ওয়ার্কশপেই থেকে যেতে হয়েছিল? না অন্য কারণ আছে, যা এখনও অজানা? অভিজিতের ব্যাপারে আরও খোঁজখবর প্রয়োজন।
মোট আটটা ‘রেইড পার্টি’ ঘটনার দিন রাতেই গঠন করে দিয়েছিলেন এসপি। যার প্রতিটির নেতৃত্বে ছিলেন পোড়খাওয়া ইনস্পেকটররা। টিমগুলো কোথায় কখন যাবে, কোন সোর্স ইনপুটটা কখন ফলো-আপ করবে, তার সমন্বয়ে ছিলেন এসডিপিও ব্যারাকপুর সুমনজিৎ রায়। পুলিশ সুপারের অগাধ আস্থা ছিল সুমনজিতের উপর। কারণও ছিল। মেধাবী এবং পরিশ্রমী এই অফিসারকে ক্রাইম ওয়ার্কে বরাবর সহজাত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে দেখেছেন।
জেলার এবং আশেপাশের সমস্ত সক্রিয় ডাকাতদলের তালিকা তৈরি করে শুরু হল নির্বিচার ‘রেইড’। সামান্যতম সন্দেহ হলেই থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ। প্রতিটা টিমের সঙ্গে থাকছিল বাছাই করা সোর্সরা। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঘটনা ঘটেছিল। পরের বাহাত্তর ঘণ্টায় জেলা পুলিশের তল্লাশি-বাহিনী চষে ফেলেছিল জেলার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম। চষে ফেলেছিল হাওড়া-হুগলি-নদিয়া-দক্ষিণ ২৪ পরগনারও একটা বিস্তীর্ণ অংশ। অন্তত কুড়ি-বাইশ জন সন্দেহভাজনকে তুলে আনা হয়েছিল, যারা দাগি ডাকাত হিসেবে পরিচিত। লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ করেও যাদের কারও বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না কাঁচড়াপাড়ার ঘটনায় জড়িত থাকার।
প্রথম ‘ব্রেক থ্রু’-র আভাস মিলল ২৬ ফেব্রুয়ারির রাতে। সোর্সের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে ঘোলা থানার তালবান্দা এলাকার একটা ভাড়াবাড়ি থেকে গভীর রাতের রেইডে গ্রেফতার হল ছয়জনের একটা গ্যাং। সূর্য গোলদার, বাবর আলি মণ্ডল, রতন তরাই, সুরজিৎ দাস, বিশ্বজিৎ মণ্ডল আর তাপস বিশ্বাস। ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত হল চারটে শাবল, দুটো দেশি পিস্তল এবং আটটা কার্তুজ। তবে আগ্নেয়াস্ত্র বা কার্তুজ নয়, উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠার উপাদান ছিল অন্যত্র। সূর্য গোলদারের একটা মাঝারি সাইজ়ের টিনের সুটকেসে। যেটা খুলতেই বেরল চামড়ার বেল্ট, টোটা রাখার। ঠিক যেমনটা বলেছিলেন বিমল, ‘একজনের গায়ে আড়াআড়িভাবে টোটাভরতি চামড়ার বেল্ট ছিল…।’ এই বেল্টটায় অবশ্য টোটা ছিল না একটাও।
কেস তা হলে সমাধানের পথে? স্থানীয় গ্যাং বলতে তা হলে এরাই? কিন্তু লুঠের মাল? তন্নতন্ন করে খুঁজেও ঘর থেকে পাওয়া গেল না কিছু। গ্রেফতার করে বীজপুর থানায় নিয়ে গিয়ে চলল ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ। পুলিশি জেরার যাবতীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করেও স্বীকারোক্তি এল না। হাজার চাপের মুখেও ভাঙা তো দূরের কথা, সামান্য মচকালও না কেউ, ‘আমরা কিছু জানি না এই ডাকাতির ব্যাপারে, বিশ্বাস করুন স্যার।’ সূর্য গোলদারকে চেপে ধরা হল, ‘চামড়ার বেল্টটা তোর কাছে কী করে এল?’ সূর্য একই কথা বলে চলল, ‘এটা অনেকদিনের পুরনো। কল্যাণীতে একটা ডাকাতিতে কাজে এসেছিল। চাঁদনি মার্কেট থেকে শখ করে কিনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু কাঁচড়াপাড়ার ডাকাতিতে ছিলাম না স্যার।’
ধৃত ছ’জনের ক্লোজ়-আপ ছবি দেখানো হল বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎকে। তিনজনের থেকেই একটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের উত্তর এল, ‘মনে তো হচ্ছে এই দুটো লোক ছিল। তবে শিয়োর নই। আসলে কয়েকজনের মুখ বাঁধা ছিল তো… আর ভয়ে তো ওদের মুখের দিকে তাকাতেই পারিনি বেশিক্ষণ… যা করতে বলছিল, করে যাচ্ছিলাম শুধু।’ দেখানো হল বেল্টটাও। যেটা দেখামাত্রই অবশ্য বিমল বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবিকল এইরকমই তো ছিল!’ নিরঞ্জন-অভিজিৎ অত নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না, ‘ঠিক এমনটাই ছিল কি না মনে পড়ছে না স্যার!’