দ্বিতীয়ত, শুধু তিন-চারজনের বর্ণনা আপাতত পাওয়া যাচ্ছে তিনজনের বয়ানে, যার ভিত্তিতে ‘পোর্ট্রেট পার্লে’, অর্থাৎ ছবি আঁকানোর চেষ্টা করা যায়। দেখলে বাচ্চা-বাচ্চা মনে হয় এমন একজন। চৌকোটে মুখ একজনের। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখের আরেকজন। ভারী চেহারা, পাতলা চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির একজন। বাকিদের মধ্যে যাদের মুখ বাঁধা ছিল না, তাদের ব্যাপারে জানতে চাইলে মোটামুটি একই উত্তর আসছে তিনজনের থেকে, ‘এত ভয় পেয়ে গেছিলাম, ডিটেলে খেয়াল করার মতো অবস্থা ছিল না।’ বেশ, কিন্তু যাদের বর্ণনা দিতে পারছেন, তাদেরই বা ডিটেল কোথায় সেভাবে? চৌকোটে মুখ বা বাচ্চা-বাচ্চা দেখতে বা অল্প চুলের ভারী চেহারার লোক… এমন শ’খানেক লোক তো এই কাঁচড়াপাড়াতেই খুঁজলে পাওয়া যাবে। তবু যা পাওয়া গেছে, তা-ই সই। বর্ণনা অনুযায়ী ছবি আঁকানো হোক সিআইডি-তে বিমলদের পাঠিয়ে। সেই ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হোক সোর্সদের মধ্যে।
তিন নম্বর, চন্দনার মোবাইলটা নিয়ে গেছে ডাকাতরা। তারপর থেকেই বন্ধ। প্রত্যাশিতভাবেই। আইএমইআই (international mobile equipment identity। প্রতিটি মোবাইল ফোনের জন্য নির্দিষ্ট ‘ইউনিক’ বা অনন্য নম্বর, যা সাধারণত ফোনের ব্যাটারির পিছনে লেখা থাকে) সার্চে দিয়ে রাখতে হবে লুঠ হওয়া মোবাইলের নম্বরটা। আজ-কাল-পরশু-তরশু বা এক-দু’মাস পরে, মোবাইলটা খুলে যখনই কেউ ওতে অন্য সিম ভরে ফোন চালু করবে, আইএমইআই নম্বরের সূত্রে জানা যাবে ফোনের অবস্থান।
মোবাইল ফোনের ঘাঁতঘোঁত সবাই মোটামুটি জেনেই গেছে আজকাল। সিম না বদলে চুরি করা ফোন ব্যবহার করার বোকামো ছিঁচকে মোবাইল চোররাও করে না। আর এরা তো ডাকাতদের গ্যাং পুরোদস্তুর। সুতরাং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, ফোন কখন চালু হয়, কখন ঢোকানো হয় অন্য সিম। মোবাইলটা যে নিয়ে গেছে, এটা একদিক থেকে খুবই আশাপ্রদ তদন্তের পক্ষে। ভাল হয়েছে, নিয়ে গেছে। একবার ফোনটা চালু হলেই তৎক্ষণাৎ চালু হবে প্রযুক্তি-প্রহরা।
চার নম্বর, এই ধরনের দুঃসাহসিক ডাকাতি কোনও নতুন আনকোরা গ্যাংয়ের কাজ নয়। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, অন্য রাজ্যের কোনও পেশাদার ডাকাতদল স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতীকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করেছে। বিমলরা বলেছেন, ডাকাতদের একজনের গায়ে টোটাভরতি চামড়ার বেল্ট ছিল। যেমনটা দেখা যায় সিনেমায়, চম্বলের ডাকাতদের শরীরে। বন্দুক নিয়ে, গব্বর সিং স্টাইলে গুলিভরতি বেল্ট নিয়ে এভাবে ডাকাতি শেষ কবে হয়েছে এ রাজ্যে? আদৌ হয়েছে? যদি বা হয়েও থাকে, কোথায় হয়েছে? কিনারা হয়েছিল? খোঁজ নিতে হবে। দলটা যে অত্যন্ত বেপরোয়া, সন্দেহাতীত। না হলে সামান্যতম প্রতিরোধেই এভাবে নির্মম নির্বিকার ছুড়ে ফেলে দেয় এক মহিলাকে!!! কোথাকার গ্যাং এরা?
ফ্রিজের উপর ডাকাতদের ফেলে যাওয়া তেলের শিশি ইঙ্গিত দিচ্ছে, গ্যাং সম্ভবত উত্তরপ্রদেশের। শুধু হিন্দিতে কথা বলছিল বলে নয়। শিশির লেবেলের উপর ‘উত্তরপ্রদেশ’ লেখা আছে বলে নয়। অভিজ্ঞ তেল-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, শিশির উপর ‘হিমতাজ’-এর যে লেবেলটা আছে, সেটা আসল ‘হিমতাজ’ তেলের নয়। ডুপ্লিকেট। এবং সেটা এ রাজ্যে বিক্রি হয় না। ব্র্যান্ডের জাল লেবেল বানিয়ে এই তেল অনেক কম দামে যথেচ্ছ বিকোয় উত্তরপ্রদেশ-বিহারে।
পয়েন্ট নম্বর পাঁচ, উত্তরপ্রদেশ হোক, বিহার হোক, যে রাজ্যই হোক, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে যখন ন্যূনতম সংশয়ও নেই, আপাতত ‘ফোকাস’ করতে হবে উত্তর ২৪ পরগনা এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর উপর। হাওড়া-হুগলি-নদিয়া-দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এমনকী বর্ধমান-বীরভূমেও গত চার-পাঁচ বছরে যা যা ডাকাতি হয়েছে, সিআইডি-তে গিয়ে রেকর্ড ঘেঁটে দেখতে হবে। ক’টার কিনারা হয়েছিল? কারা করেছিল? তারা এখন কোথায়? জেলে, না জামিনে বাইরে? বাইরে থাকলে সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্পর্কে খবর নিতে হবে।
সিটের সদস্যদের তো বটেই, জেলার সমস্ত ওসি-কেও বলা হল, যার যেখানে যা সোর্স আছে, সবাইকে কাজে লাগাতে হবে মরণবাঁচন ক্ষিপ্রতায়। যেভাবেই হোক, ‘ব্রেক-থ্রু’ চাই। জেলায় এবং সিআইডি-র ক্রাইম রেকর্ডস সেকশনে পুরনো দাগি ডাকাতদের যত ছবি আছে, দেখানো হল বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎকে, ‘এদের মধ্যে কেউ ছিল কি?’ বিমলরা চিনতে পারলেন না।
অবশ্য বিমল যা বলছেন, সেটাকেও ধ্রুবসত্য বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছিল না আর। ‘ক্রাইম রিকন্সট্রাকশন’ এই জাতীয় মামলায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা যাতে নির্ভুল হয়, তাই ডাকাতির দিনই শুধু নয়, তার পরের দু’দিনও বিমলকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রতিবারই বয়ানের কিছু না কিছু বদলাচ্ছিলেন। ঘটনার দিন বলেছিলেন, তিন-চারজনের মুখ বাঁধা ছিল। তার দু’দিন পর বললেন, ‘সাত-আটজনের মুখে কাপড় ছিল।’ আগে যে অন্য কথা বলেছিলেন?—‘মাথার ঠিক ছিল না ওভাবে ডাকাতি হওয়াতে। ওভাবে স্ত্রী-কে চোখের সামনে ফেলে দিতে দেখে। শকের মধ্যে ছিলাম।’
‘শক’ পাওয়ার মতোই ঘটনা, কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু এত কিছু যে ঘটে গেল, মেয়ের ঘুম ভাঙল না? পাড়াপ্রতিবেশীরাও আঁচ পেলেন না কিছু? বিমলের জবাব, ‘মেয়ে অনেক রাত অবধি পড়ার পর অঘোরে ঘুমচ্ছিল। আমরা তো দু’-তিনবার ‘‘ডাকাত ডাকাত’’ বলার পর আর কিছু বলার সুযোগই পাইনি।’ বেশ, হতেই পারে। কিন্তু স্থানীয় সোর্স মারফত একটা খবর আসছিল, মাসকয়েক আগে চন্দনার নামে নাকি আশি লক্ষ টাকার লাইফ ইনশিয়োরেন্স করেছেন বিমল। এত টাকার বিমা হঠাৎ? বিমল সরাসরি অস্বীকার করলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না এমন কোনও ইনশিয়োরেন্সের! এসব আমার শত্রুপক্ষ রটাচ্ছে।’