মানুষটাই যখন নেই আর, পরিচয় গোপন করাটা প্রহসন। এসডিপিও উত্তর দেন শান্ত গলায়, ‘সোর্স ছিল আমার। উত্তরপাড়ার ছেলে। কেউ জানত না যে ও সোর্স। খুব রিলায়েবল ছিল। অসম্ভব সাহস… দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক…পিনপয়েন্ট খবর দিত… দিন দশেক আগের মহেশতলার রেইডটার ইনপুটগুলো ওরই ছিল…’
চুপ করে থাকেন ওসি। তিনি নিজেও মহেশতলার ওই রেইডে ছিলেন। মহেশতলা থানা থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে একটা তেমাথা মোড়। মোড়ের মাথায় একটা পানবিড়ির দোকান। যার থেকে বাঁ হাতে কয়েকশো মিটার হেঁটে গেলে দোতলা বাড়ি একটা। দোতলাটা ভাল করে ঢালাই হওয়া বাকি এখনও। এসডিপিও সাহেবের কাছে খবর ছিল, একতলায় পালের গোদা সহ ফুল টিম-কে পাওয়া যাবে রাত সাড়ে বারোটার পর। মদ-মাংস-মোচ্ছবের ঢালাও আয়োজন থাকবে মধ্যরাতের ‘ঠেক’-এ।
কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়, বাদ সেধেছিল সন্ধে থেকে অঝোর বৃষ্টি। ‘মুভমেন্ট’ যতটা গোপন রাখা উচিত, ততটা রাখা যায়নি। ওই আকাশ-ভাঙা বৃষ্টির মধ্যেও বাড়িটাকে ‘কর্ডন’ করা হয়েছিল সোয়া একটা নাগাদ। কাউকে পাওয়া যায়নি। যাদের ধরতে যাওয়া, তারা যে কোনওভাবেই হোক, রেইডের আঁচ পেয়ে গিয়েছিল। সোর্সের সেদিনের খবর যে একশো শতাংশ ঠিক ছিল, সে তো এই ছিন্নভিন্ন লাশই জানান দিচ্ছে। বাংলা হিসেব, পুলিশের ‘সোর্স’ হওয়ার চরম মাশুল দিতে হয়েছে এই যুবককে।
বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানোর ব্যবস্থা করে গাড়িতে ওঠেন এসডিপিও। রহস্যের ‘র’-ও নেই এখানে। তদন্তেরও ‘ত’ নেই। খুনটা কে করেছে, কেন করেছে, সে নিয়ে ভাবারও কিছু নেই।রিষড়া রেলগেটের লেভেল ক্রসিংটাও জানে।
হুব্বা। হুব্বা শ্যামল।
.
সন্ধে নেমেছে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তের ব্রিফিং সেরে নিচ্ছেন ডিআইজি সিআইডি (অপারেশনস), যাঁকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অফিসাররা। মন দিয়ে শুনছেন প্রতিটা শব্দ।
—আর্মস থাকবে না ওদের কাছে, এটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর! সুতরাং ক্রসফায়ার আউট অফ কোয়েশ্চেন। যদি পালানোর চেষ্টা করে, কেউ ফায়ার করবে না। জানি, প্রাইজ ক্যাচ, কিন্তু ফায়ারিং আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস…আই রিপিট… আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস। ভিড়ের মধ্যে পাবলিকের কোনও ইনজুরি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে… প্লিজ় কিপ দিস ইন মাইন্ড। তেমন হলে জাস্ট দৌড়ে চেজ় করবে… নাথিং মোর। দৌড়ে কোথায় যাবে, কতদূর পালাবে? ধরা পড়বেই। গাড়িদুটো কোথায় থাকবে সেটা আরেকবার বুঝে নাও ভাল করে। পেয়ে গেলে সোজা এনে গাড়িতে তুলব আমরা। আর বেশি সময় নেই হাতে… জাস্ট অ্যাবাউট হাফ অ্যান আওয়ার…কোনও ডাউট আছে কারও? এনি কোয়েশ্চেনস?
উত্তর আসে সমস্বরে, ‘নো স্যার!’
.
‘ডন’। শব্দটা ইদানীং অপাত্রে দান করে মিডিয়া। মাঝারি মাপের কোনও স্থানীয় গুন্ডা-মস্তানের নামের আগেও ‘ডন’ বা ‘গ্যাংস্টার’ বসিয়ে দেওয়াটা আজকাল নেহাতই সাধারণ ঘটনা।
এ কাহিনি তেমন কোনও রাম-শ্যাম-যদু গোত্রের মস্তানকে নিয়ে নয়। খুচরো গুন্ডামি আর টুকরো মস্তানির সীমানা ছাড়িয়ে কীভাবে আক্ষরিক অর্থেই ‘ডন’ হয়ে উঠেছিল হতদরিদ্র পরিবারের এক অশিক্ষিত যুবক, পুলিশকে প্রায় দুই দশক ধরে নাকানিচোবানি খাইয়ে অপরাধ-দুনিয়ায় কীভাবে কায়েম করেছিল একাধিপত্য, তার কিছুটা ধরা থাকল এ কাহিনিতে। ধরা থাকল পুলিশের সঙ্গে ধারাবাহিক টক্করের ইতিবৃত্ত। এবং পরিণতি।
শ্যামল দাস। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বাবা শ্রমিক, হুগলির শ্রীদুর্গা কটন মিলে। কোন্নগরের ধর্মডাঙায় একটা বাড়িতে কোনওমতে সপরিবার দিন গুজরান। পাড়ার স্কুলে বাবা ভরতি করিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেদের। কিন্তু ক্লাস থ্রি-র বেশি আর পড়াশুনো এগোয়নি শ্যামলের। মা-বাবার হাজার বাবা-বাছা সত্ত্বেও যেতই না স্কুলে। আর গেলেও পালিয়ে আসত একটা-দুটো ক্লাসের পরেই। রিষড়া রেলগেটের কাছে গিয়ে মালগাড়ির আসা-যাওয়া দেখত। ভাবত, মালগাড়ি বলে কেন? কী ‘মাল’ থাকে ওই ইয়া ইয়া বগিগুলোর ভিতরে? কারা পাঠায়? কোথায় পাঠায়?
স্কুলের পাট চুকে যাওয়ার পর কিশোর শ্যামলের দিন কাটত ঘুঁটে দিতে মা-কে সাহায্য করে। আর রাতটা কাটত বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। দোসর ছিল ঠিক উপরের দাদা বাচ্চু। স্কুলের মায়া সে ক্লাস ফাইভেই কাটিয়ে দিয়েছিল। আটের দশকের শুরুর দিক তখন। দুই ভাই মিলে খুঁজে বেড়াত টাকা রোজগারের সহজ উপায়। চোদ্দো বছর বয়েসেই বিড়ি আর ‘বাংলা’-য় বউনি। নেশার খরচটা তো অন্তত তুলতে হবে। বাবা একদিন খুব বকাঝকা করলেন শ্যামল-বাচ্চুকে। বাচ্চু চুপ করে থাকল। শ্যামল অবশ্য চুপ করে বকুনি হজম করার বান্দা নয়। বাবার মুখের উপর সরাসরি বলে দিল, ‘তোমার মতো মজুরগিরি আমি করব না। তার চেয়ে ওয়াগন ভাঙলে অনেক বেশি টাকা। আমি নিজেরটা নিজে বুঝে নেব।’ বাবা কাঞ্জিলাল দাস বুঝে গেলেন, এ ছেলে পোষ মানার নয়। এই বয়সে নিজেরটা নিজেই বুঝে নেবে বলছে। ঠিকই বলছে বোধহয়। না হলে চোদ্দো বছর বয়সে বুঝে যায় ওয়াগন ভাঙার হিসেব! মুখের উপর তেড়িয়া মেজাজে বলে দেয়, ‘মজুরগিরি করব না!’
‘ওয়াগন ব্রেকিং’-এ শ্যামলের হাতেখড়ি অবশ্য বছরদুয়েক পরে। ক্রিমিনাল কেরিয়ারের শুরু তারও আগে, স্থানীয় আইসিআই ফ্যাক্টরির মালপত্র চুরি করা দিয়ে। যে ফ্যাক্টরির স্থানীয় নাম ‘অ্যালকালি’। রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা মালপত্র বেচে যা আসত, তাতে আর কতটুকু হত? মাসে দুটোর বেশি সিনেমা দেখা যেত না। সপ্তাহে একদিনের বেশি ‘ইংলিশ’ খাওয়া যেত না। পকেটে পয়সা না থাকায় মাঝপথে জুয়ার বোর্ড ছেড়ে উঠে যেতে হত। অ্যালকালি ফ্যাক্টরির পাশের মাঠে বসে শ্যামল ক্ষোভ উগরে দিত বন্ধুদের কাছে, ‘ধুর, এভাবে বাঁচা তো সেই মিল মজদুরের বাঁচাই হল।’