এই ব্র্যান্ডের তেল ব্যবহার করেননি কস্মিনকালেও, জানালেন বিমল। এমন কি হতে পারে, বাড়িতে যে মিস্ত্রিরা কাজ করছে, শিশিটা তাদের কারও? বিমল বললেন, ‘কোনও চান্স নেই। চারতলায় মিস্ত্রিরা কাজ করে ঘরের বাইরে। ছাদের অংশে মূলত। ভিতরে ঢোকার দরকার প্রায় পড়েই না।’ আর ঢুকলেও তেলের শিশি নিয়ে ঢুকবেই বা কেন, আর ঢুকলেও ফেলেই বা রেখে যাবে কেন? এই শিশি ছিল না কাল রাতে ফ্রিজের উপর, বিমল বললেন একশো শতাংশ নিশ্চিত ভঙ্গিতে। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই, তেলের শিশি ডাকাতরাই সঙ্গে এনেছিল নির্ঘাত। ফেলে গেছে তাড়াহুড়োয়।
দুই, ওয়ার্কশপের এককোণে পড়ে থাকা দুটো শাবল। একটা পলিথিনের ব্যাগ। নিশ্চিত, ডাকাতদেরই ফেলে যাওয়া। শাবল দুটোয় পাওয়া গেল ফিঙ্গারপ্রিন্ট।
তিন, দোকানের একটা আলমারির পাশে পড়ে থাকা একটা ভাঁজ করা কাগজ। ভাঁজ খুলে দেখা গেল, ওটা আসলে ম্যাপ। কাঁচা হাতে পেনসিলে আঁকা। কিসের ম্যাপ? বিমলের চারতলা বাড়ির। কোন তলায় কোথায় কী, ম্যাপে চোখ বোলালে জলবৎ তরলং।
ও হ্যাঁ, বলা হয়নি, ব্যারাকপুরের পুলিশ ট্রেনিং কলেজ থেকে সকালেই তলব করা হয়েছিল ডগ-স্কোয়াড-এর পিঙ্কিকে। পিঙ্কি ঘুরেছিল পুরো চত্বরটা। শুঁকে দেখেছিল ডাকাতদের ফেলে যাওয়া পলিথিন ব্যাগ আর ‘হিমতাজ’ তেলের শিশি। বাড়ির সামনের যে রাস্তাটা সোজা চলে যাচ্ছে কাঁচড়াপাড়া স্টেশনের দিকে, পিঙ্কি ছুটেছিল সেদিকে। স্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে থমকে গিয়েছিল। ডাকাতরা যে রেলপথেই পালিয়েছে, সেটা এমনিতেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল। পিঙ্কির গতিবিধি সেই আন্দাজকে আরও জোরালো করেছিল।
ডাকাতিতে বাধা দিতে গিয়ে গৃহবধূ খুন। শুধু খুন নয়, চারতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নৃশংসতম খুন। স্থানীয় থানা থেকে মাত্র দুশো মিটার দূরত্বে! শোরগোল পড়ে গিয়েছিল রাজ্যে। মিডিয়ার দৈনন্দিন হইহই তো ছেড়েই দিলাম, পুলিশের উপর উত্তুঙ্গ চাপ তৈরি হচ্ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির তরফেও। ঘটনার দ্রুত সমাধানের দাবি নিয়ে থানা ঘেরাও, এসপি-র অফিসে ডেপুটেশন, এলাকায় ব্যবসায়ী ধর্মঘটের ডাক দেওয়া, ‘পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে একজোট হন’ জাতীয় লিফলেট বিলি করা—কিছুই বাকি ছিল না।
অ্যাডিশনাল এসপি আর এসডিপিও-র নেতৃত্বে জেলার বাছাই করা অফিসারদের নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেও সামলানো যাচ্ছিল না ওই বহুমুখী চাপ। যা হট্টগোল চলছিল চন্দনা-হত্যা নিয়ে, আঁচ পৌঁছেছিল রাইটার্সেও। ঘটনার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে জারি হয়েছিল আইসি বীজপুরের বদলির আদেশ। নতুন আইসি হিসেবে ২৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইনস্পেকটর প্রবীর সান্যাল। সিআইডি-তে অনেকটাই কেটেছে যাঁর কর্মজীবন, যাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল বহু জটিল কেসের সমাধানে।
শুরুর দিনতিনেক তদন্তের ভার ছিল বীজপুর থানার সাব-ইনস্পেকটর মনিরুল ইসলাম সরকারের উপর। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে থানার চার্জ নেওয়ার দিনই তদন্তভার প্রবীরকে দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার, ‘এমন কেস তো রোজ রোজ হয় না প্রবীর… তাই আপনাকে দিলাম… বুঝতেই তো পারছেন, এই কেসটা দ্রুত ডিটেক্ট করে কনভিকশন না করাতে পারলে আমরা কেউই মুখ দেখানোর জায়গায় থাকব না। যারা এভাবে মেরে ফেলল এক মহিলাকে, তাদের যদি শাস্তি না দেওয়া যায়…।’ কথা শেষ করেননি এসপি। করার দরকারও ছিল না। প্রবীর দিব্যি শুনতে পেয়েছিলেন না-বলা শব্দগুলো, ‘তা হলে আর চাকরি করে কী লাভ?’
স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের সঙ্গে ঘটনার দিন থেকেই রোজ অন্তত ঘণ্টাতিনেক বসছিলেন পুলিশ সুপার। বীজপুর থানাতেই দিনের সিংহভাগ কাটাচ্ছিলেন। কী কী জানা যাচ্ছে আপাতত, কী কী জানার আছে আরও, কী কী করণীয় এখন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছিল সবটা।
প্রথম কথা, বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎদের বয়ান থেকে পাওয়া যাচ্ছে, গ্যাংটা ছিল মোটামুটি বারো-চোদ্দো জনের। কিছু লোক হিন্দিতে কথা বলছিল। কয়েকজন বাংলায়। তিন-চারজনের মুখ ঢাকা ছিল। অর্থাৎ, যদি ভিনরাজ্যের গ্যাংই হয়, সঙ্গে বঙ্গভাষী দুষ্কৃতীও ছিল, যাদের স্থানীয় হওয়ারই সম্ভাবনা। লোকাল গ্যাং হলেই সাধারণত মুখ বেঁধে ক্রাইম করে। যাতে চেহারার বর্ণনা শুনে পুলিশ চট করে ‘আইডেন্টিফাই’ না করতে পারে।
তা ছাড়া বিমলের বাড়ির নকশা যখন পাওয়া গেছে, এমন কেউ বা কারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আছে, যার বা যাদের যাতায়াত ছিল বাড়িতেও। যে বা যারা জানত নিখুঁত, কোথায় কী আছে। কে বা কারা? বাড়ির কাজের লোক হতে পারে। দোকানের কর্মচারী হতে পারে। বাড়িতে কাজ হচ্ছিল দু’মাস ধরে। রোজ অনেক মিস্ত্রির যাতায়াত ছিল। তাদেরও কেউ হতে পারে।
তালিকা তৈরি করতে হবে সবার, যাদের পক্ষে সম্ভব বাড়ির নকশা বানানো বা বানাতে সাহায্য করা। বাড়ির কাজের মাসি, দুধওয়ালা, খবরের কাগজওয়ালা, জমাদার… কেউ যেন বাদ না যায়। প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। মিস্ত্রিদের তালিকা তৈরি করে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ দরকার। কল ডিটেলসও নিতে হবে সবার। কোনও কর্মচারীকে কি বিমল সাম্প্রতিক অতীতে ছাঁটাই করেছিলেন? সেই থেকে কোনও শত্রুতার অ্যাঙ্গল? খবর নেওয়া দরকার আত্মীয়-পরিজন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপারে। কাদের কাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল বিমলদের বাড়িতে, সেটুকু অন্তত জানতেই হবে।