‘ওরা যা বলছিল, আমি যন্ত্রের মতো করে যাচ্ছিলাম। সিন্দুকের চাবি দেখিয়ে দিলাম। ওরা সিন্দুক আর শোকেসের ড্রয়ার খুলে সমস্ত সোনা এবং রুপোর গয়না বের করে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিল। কিচ্ছু বাদ রাখল না। অন্তত ঘণ্টাখানেক ধরে সব হাঁটকাল। তারপর দোকানের বাইরে নিয়ে এসে আমাদের শাসাল একবার। স্টেশনের দিকে তারপর চলে গেল পায়ে হেঁটে। ভোর হয়ে গেছে তখন। আমি, নিরঞ্জন আর অভিজিৎ ছুটলাম বাড়ির পিছনদিকে। দেখলাম, বাড়ির পিছন দিকের গলিতে রক্তাক্ত অবস্থায় চন্দনা পড়ে আছে।
‘দেখে যা মনে হয়েছিল, ওদের বেশিরভাগের বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের কাছাকাছি হবে। আমি কয়েকজন ডাকাতকে ভালভাবে দেখেছি, যাদের মুখ ঢাকা ছিল না। একজনের অবশ্য বয়স তুলনায় কমের দিকে ছিল। মুখটা বেশ বাচ্চা-বাচ্চা। একজন ছিল চৌকোটে মুখের। আরেকজনের চোখদুটো মনে আছে। যেন কোটরে ঢোকা। একটা লোক সামান্য ভারী চেহারার ছিল। বেঁটে। চুল পাতলা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এ বারান্দায় ছিল। এর মুখটা স্পষ্ট মনে আছে। এই লোকটাই চন্দনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। একেই দলটার লিডার মনে হয়েছিল। বাকিদের সঙ্গে ধমকে কথা বলছিল।’
নিরঞ্জন আর অভিজিতের বয়ানও হুবহুই মিলে গেল বিমলের সঙ্গে। বিদ্যুতের সঙ্গে কথা বলার প্রশ্নই ছিল না। আট বছরের ছেলে। চোখের সামনে মা-কে বারান্দা থেকে ঠেলে ফেলে দিতে দেখেছে ডাকাতদের। প্রায় বাক্রুদ্ধ হয়ে গেছে। কেঁদেই চলেছে দিদির কোলে মাথা রেখে। ‘দিদি’কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘রাত্রে কিছু টের পাওনি?’
—না… প্রায় রাত দুটো অবধি পড়াশুনো করে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার কানে আসেনি কিছু।
দোকান আর ওয়ার্কশপ একরকম ফাঁকাই করে দিয়ে গেছে ডাকাতরা। কত টাকার গয়না লুঠ হয়েছে? এফআইআর-এ বিমল যা লিস্ট দিয়েছেন, কমপক্ষে লাখ বিশেক টাকার মাল তো গেছেই। শোয়ার ঘরের টেবিলে পড়ে থাকা চন্দনার মোবাইল ফোনটাও নিয়ে গেছে ডাকাতরা। বিমলের ফোনটা বেঁচে গেছে। অত গয়নাগাটি লুঠের ফাঁকে ডাকাতরা বিমলের ফোনটা নেওয়ার কথা খেয়াল করেনি সম্ভবত।
কীভাবে চারতলায় উঠেছিল ডাকাতরা, সেটা স্পষ্ট। বাড়ির পিছনের দিকে বাঁশের ভারা বাঁধা ছিল মাসদেড়েক ধরে। ডাকাতরা ছাদে উঠেছিল সেখান দিয়েই। উঠে একটা দল ছাদের খোলা অংশ দিয়ে চলে গিয়েছিল শোয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। আরেক দল চারতলার কোলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করছিল। বিমলের বয়ান অনুযায়ী, সবাই উপরে ওঠেনি। একতলায় দোকানের শাটার ভাঙার কাজে হাত লাগিয়েছিল আরও জনাচারেক।
ঘটনাস্থল খুঁটিয়ে দেখে আরও বোঝা গেল, চন্দনাদেবীর দেহ বাড়ির পিছনের যে গলিতে আবিষ্কৃত হয়েছিল, আদতে সেখানে তিনি পড়েননি। পড়েছিলেন বড় রাস্তার উপর। সেখানে রক্তের দাগ ছিল জমাট বেঁধে। বেরিয়ে এসেছিল ঘিলুর কিছু অংশ। পালিয়ে যাওয়ার সময় দেহটাকে টেনে-হিঁচড়ে ডাকাতরাই গলিতে রেখে গিয়েছিল। রাস্তার রক্তের রেখায় সে গতিপথ স্পষ্ট।
ফরেনসিক টিম পৌঁছে গেছে। চারতলা বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জরিপ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিস্তারিত সিজ়ার লিস্ট তৈরির। জেলা পুলিশের ‘এভিডেন্স রিকভারি ভ্যান’-ও এসে গেছে। কিন্তু ‘এভিডেন্স’ অক্ষত থাকলে তবে না ‘রিকভারি’? ঘটনাস্থলের পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক পরীক্ষার আগেই যদি শ’খানেক বাইরের লোক সেখানে চলাফেরা করে যত্রতত্র, জিনিসপত্র ছুঁয়ে দেখে ইচ্ছেমতো, অপরাধীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফুটপ্রিন্ট পাওয়ার সম্ভাবনার বারোটা বেজে যায়। বহু লোকের হাত-পায়ের ছাপে তালগোল পাকিয়ে যায় সব। ঠিক যেমনটা হল বাড়ির ফরেনসিক পরীক্ষার সময়।
পুরো বাড়িটায় স্থানীয় কৌতূহলী জনতা যেমন খুশি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়িয়েছে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর। দোকানের শোকেস বা ওয়ার্কশপের মেশিনে অসংখ্য হাত পড়েছে অসংখ্যবার। নষ্ট হয়ে গেছে নির্দিষ্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট চিহ্নিত করে সংগ্রহ করার সুযোগ। তন্নতন্ন করে খুঁজে সম্ভাব্য অপরাধীদের হাতের আর পায়ের ছাপ কিছু পাওয়া গেল চারতলার ফ্রিজে, আলমারিতে। কিছু সংগ্রহ করা হল দোকানের শোকেসের একেবারে উপরের দিকের র্যাকগুলো থেকে, যেখানে ঘটনা-পরবর্তী ভিড়ের হাত পৌঁছয়নি।
চারতলার কোলাপসিবল গেট আর নীচে দোকানের ভাঙা শাটার থেকে সংগৃহীত হল ‘tool marks’। সহজ ভাষায় বলি। ধরুন, একটা হাতুড়ি দিয়ে কোনও কিছুর উপর আঘাত করা হল। ধরুন, তালা ভাঙার জন্যই হাতুড়ি-পেটা। ভেঙে যাওয়া তালার উপর একটা দাগ থেকে যাবেই হাতুড়ির। বিজ্ঞানের একেবারে স্বাভাবিক নিয়ম। যা দিয়ে কোনও কিছুর উপর আঘাত করা হয়, তার একটা চিহ্ন থেকেই যায় লক্ষ্যবস্তুর উপর। সেই দাগ বা চিহ্নই হল ‘টুল মার্কস’। যা থেকে ফরেনসিক পরীক্ষায় আন্দাজ করা যায়, ঠিক কী জাতীয় বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। সুবিধে হয় তদন্তে। সুবিধে হয় কিনারা-উত্তর পর্যায়ে অভিযুক্তের দোষ প্রমাণে।
সিজ়ার লিস্ট তৈরি করা হল সময় নিয়ে। লম্বা তালিকা। যার মধ্যে তিনটে জিনিস বিশেষ উল্লেখের দাবি করে।
এক, চারতলায় ফ্রিজের উপর পড়ে থাকা একটা তেলের শিশি। যার উপরে হিন্দি লেবেলে লেখা ‘হিমতাজ’। লেবেলে বাকি যা কিছু লেখা, অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটের নাম-টাম পড়া গেল না কিছু। শুধু হিন্দিতে ‘উত্তরপ্রদেশ’ শব্দটা ছাড়া। শিশি খুলতেই একটা উৎকট গন্ধ ছিটকে এল। বীজপুর থানার যে অফিসাররা তৈরি করছিলেন সিজ়ার লিস্ট, তাঁদের একজন বলেই ফেললেন, ‘এ জিনিস লোকে গায়ে-মাথায় মাখে কী করে? গন্ধেই তো ভূত পালানোর জোগাড়!’