একতলায় ‘বি দাস অ্যান্ড সন্স’ নামে সোনার দোকান। দোকানের একেবারে লাগোয়াই ওয়ার্কশপ, যেখানে কারিগররা কাজ করে। দোকানের শেষ প্রান্তে একটা দরজা। যেটা খুললে উপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। দোকানের মধ্যে দিয়ে ছাড়া উপরে যাওয়ার রাস্তা নেই আপাতত।
বাড়ির লোক বলতে বিমল নিজে, স্ত্রী চন্দনা আর দুই ছেলেমেয়ে। দু’তলা আর তিনতলায় এখন কেউ থাকে না। ওখানে কাঠের কাজ চলছে। কাজ চলছে আসবাবপত্র পালিশেরও। চারতলায় সপরিবারে থাকেন বিমল। তিনটে ঘর। সঙ্গে ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং। একটা ঘরে বিমল আর চন্দনার সঙ্গে শোয় আট বছরের ছেলে বিদ্যুৎ। অন্য একটা ঘরে থাকে আঠারো বছরের মেয়ে অনিন্দিতা। একটা ঘর খালিই পড়ে থাকে। আত্মীয়স্বজন এসে পড়লে ব্যবহার হয় কদাচিৎ। চারতলাটাও যে পুরোপুরি তৈরি, এমন নয়। এখনও অসম্পূর্ণই। বিমলদের থাকার অংশটার পাশে অনেকটা জায়গা এখনও খোলা ছাদ। ঘরে ঢোকার দরজাটা ছাদ-সংলগ্ন। দরজার সামনে কোলাপসিবল গেট।
শোয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দাতেও এখনও গ্রিল বসানো হয়নি। স্রেফ ঢালাই হয়েছে। ভারা বেঁধে মিস্ত্রিরা কাজ করছে দিনরাত। বিমলের ভাবাই আছে, দু’তলা-তিনতলাটা তৈরি হয়ে গেলে নীচে নেমে আসবেন সপরিবার। ওয়ার্কশপটা প্রয়োজনে চারতলায় তুলে আনবেন।
দোকান আর বাড়ি মিলিয়ে কুড়িজন কর্মচারী। যারা বাড়ির কাজকর্ম করে, তারা কেউ স্থায়ী নয়। রোজকার কাজ করে চলে যায়। কর্মচারীরাও রাত সাড়ে আটটা-ন’টার মধ্যে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে যে যার বাড়ি চলে যায়। শুধু বহুদিনের পুরনো কর্মচারী কাম ম্যানেজার নিরঞ্জন পাল প্রায় প্রতি রাতই ওয়ার্কশপের ঘরে কাটান। ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে রোজকার মতোই দোকানের ঝাঁপ পড়ার পর নিরঞ্জন সব তালা বন্ধ করে চাবির গোছা বিমলকে চারতলায় দিয়ে আসেন সোয়া ন’টা নাগাদ। তারপর এসে শুয়ে পড়েন ওয়ার্কশপে। আরেকজন কর্মচারী, অভিজিৎ ভৌমিকও সে-রাতে ওয়ার্কশপে থেকে গিয়েছিলেন কাজের চাপ বেশি থাকায়।
রাত সাড়ে দশটার মধ্যে বিমলদের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গিয়েছিল। স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে বিমল শুয়ে পড়েছিলেন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে, মেয়ে তাই নিজের ঘরে রাত জেগে পড়াশুনো করছিল। এর পরের ঘটনাক্রম? থাকুক বিমলের নিজের বয়ানে।
‘আমার ঘুম ভেঙে গেছিল কুকুরের চিৎকারে। একটানা ঘেউঘেউ করেই চলেছিল কুকুরগুলো। বিছানা থেকে উঠলাম। ভাবলাম, একবার বাথরুম থেকে ঘুরে আসি। ঘরের আর ছাদের দিকের আলো জ্বালিয়ে ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুমে গেলাম। বেরিয়ে দেওয়াল-ঘড়িটা দেখলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। ছাদের দিকের কোলাপসিবল গেটের কাছে কেমন যেন একটা খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পেলাম। কারা যেন ফিসফাস কথাবার্তাও বলছে। সন্দেহ হল। ঘরের দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারতেই দেখি, গেটের সামনে চার-পাঁচজন লোক। হাতে পিস্তল-বন্দুক। শাবল দিয়ে কোলাপসিবল গেটের তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ‘‘ডাকাত! ডাকাত!’’ বলে চিৎকার করে ঘুম ভাঙালাম চন্দনার। ছেলেও উঠে পড়ল হইহল্লায়। আমি চন্দনাকে বললাম শোয়ার ঘরের বারান্দা দিয়ে ‘‘ডাকাত! ডাকাত!’’ চিৎকার করতে, যাতে পাড়াপ্রতিবেশী শুনতে পায়। চন্দনা ব্যালকনির দিকের দরজা খুলে বেরতেই দেখলাম বারান্দাতেও তিনজন লোক দাঁড়িয়ে। ওদের হাতেও পিস্তল। চন্দনা আঁতকে উঠে ‘‘ডাকাত’’ বলে চিৎকার করতেই ওরা চন্দনার মুখ চেপে ধরল।
‘চন্দনা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমি ভয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেছিলাম। ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিল। তারপর যা ঘটল, দেখে আমরা কথা হারিয়ে ফেললাম। ধস্তাধস্তির মধ্যে ওদের একজন চন্দনাকে বারান্দার ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে উপর থেকে নীচে ঠেলে ফেলে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল পুরোটা। চন্দনা আমাদের চোখের সামনে চারতলা থেকে পড়ে গেল।
‘বারান্দায় দাঁড়ানো ওই তিনজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকে মূল দরজাটা খুলে দিল। ততক্ষণে বাইরের কোলাপসিবল গেটের তালা ডাকাতরা ভেঙে ফেলেছে। আরও চার-পাঁচজন খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক বা পিস্তল… যে কোনও একটা আর্মস ছিল। একজনের বুকের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে গুলি-লাগানো বেল্ট ছিল। চম্বলের ডাকাতদের যেমন থাকে সিনেমায়, অনেকটা সেরকমই।
‘ঘরে যে ক’জন ছিল, তাদের তিন-চারজনের মুখে কাপড় বাঁধা ছিল। বাকিদের মুখ খোলা। ওদের মধ্যে একজন আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে বলল, ‘‘দুকান কি চাবি দো জলদি… নেহি তো জান সে মার ডালুঙ্গা।’’ ওদের বেশিরভাগই জড়ানো হিন্দিতে কথা বলছিল। দু’-একজন অবশ্য স্পষ্ট বাংলা বলছিল।
‘ডাকাতরা আমাকে আর ছেলেকে বন্দুক ঠেকিয়ে নীচে নিয়ে গেল। ওয়ার্কশপের ঘরের সামনে এনে বলল ঘরটা খুলে দিতে। আমি ওয়ার্কশপের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিরঞ্জনকে ডাকাডাকি করলাম। নিরঞ্জন ভিতরে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলল। ডাকাতরা ঢুকে পড়ে ওয়ার্কশপ তছনছ করা শুরু করল। অনেকটা সময় থাকল ভিতরে। ওখানে যা গয়নাগাটি ছিল, নিয়ে নিল।
‘এরপর আমাকে নিয়ে দোকানের শাটারের কাছে এল। সেখানে এসে দেখি, আরও তিন-চারজন ডাকাত আগে থেকেই মজুত। এবং তারা শাটার ভেঙে ফেলেছে। ভাঙা শাটারের নীচ দিয়ে ডাকাতরা আমাকে আর ছেলেকে নিয়ে দোকানে ঢুকল। আমাকে আলো জ্বালতে বলল দোকানের। আমি জ্বেলে দিই। এরপর আমাকে একজন পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘‘শালা সিন্দুকের চাবি চিনিয়ে দে, না হলে তোর সামনেই ছেলেকে গুলি করে মারব।’’