যে ম্যাটাডোরে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাকেশের দেহ, সেটা চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করা গিয়েছিল সহজেই। দেহ পাচারের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ম্যাটাডোর-চালকের সাক্ষ্য। যিনি ‘টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন’ প্যারেডে চিনিয়ে দিয়েছিলেন চার অভিযুক্তকে। সর্বোপরি, ফৌজদারি বিধির ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দিতে নিজেদের অপরাধ কবুল করেছিল চন্দন-জিৎ-লক্ষ্মী।
শিবু কিছুটা বেগ দিয়েছিল পুলিশকে। ধরা যায়নি তাড়াতাড়ি। শিবুকে ‘ফেরার’ দেখিয়েই চার্জশিট জমা দিয়েছিলেন তপন। প্রায় বছরখানেক চোর-পুলিশ খেলার পর ধরা পড়েছিল শিবু।
বিচারপর্ব শেষ হয়েছিল দ্রুত। রায় বেরিয়েছিল ২০১০-এর ৩০ এপ্রিল। শিবু-জিৎ-চন্দন-লক্ষ্মী, চারজনের জন্যই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বরাদ্দ করেছিলেন বারাসত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। চক্রী-চতুষ্টয় এখনও সংশোধনাগারেই।
.
সামাজিক চাপ বড় বিষম বস্তু। সামাজিক নির্মাণও। রাকেশ গুপ্তা এই চাপের শিকার হয়েছিলেন। এই নির্মাণেরই বলি হয়েছিলেন শেষ বিচারে। ভদ্রলোকের লেখা কবিতাগুলোয় স্পষ্ট বেরিয়ে আসে ওঁর সমকামী সত্তা। সামাজিক নির্মাণের ব্যাকরণে যে সত্তাকে প্রথম জীবনে নিজে চিনতে পারেননি, বা পারলেও সেই সত্তাকে তার প্রাপ্য দিতে পারেননি। সেই সত্তাকে স্বীকার করে যখন তাতে সাড়া দিতে চেয়েছিলেন, দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছিল সামাজিক চাপ।
শরীরে-মনে কী চূড়ান্ত টানাপোড়েনই না সহ্য করতে হয়েছিল ভদ্রলোককে! বাহ্যত সুখী দাম্পত্যজীবন
স্ত্রী-কন্যা নিয়ে। পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত। নিজে আদপে যা, সেটা সমাজ-সংসারে গোপন রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা একদিকে, অন্যদিকে নিজের জৈবিক চাহিদার তাড়নায় দগ্ধ হতে থাকা নিরন্তর। এবং শেষমেশ প্রাণ দেওয়া এই সংঘাতের যূপকাষ্ঠে।
কী মর্মান্তিক ট্র্যাপিজ়-জীবন! মৃত্যুই বোধহয় ছিল একমাত্র পরিত্রাণ।
৩. গন্ধটা সন্দেহজনক
—এই… থামাও এবার…
না থামিয়ে উপায়ও ছিল না অবশ্য। ড্রাইভার ব্রেক কষতে বাধ্য হলেন গন্তব্যের অন্তত দেড়শো মিটার আগে। ভিড় বলে ভিড়! সকাল পৌনে আটটা থেকে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। পুরো কাঁচড়াপাড়া অঞ্চলটাই যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। পুলিশ সুপার হাঁটতে শুরু করেন গাড়ি থেকে নেমে। স্থানীয় বীজপুর থানার অফিসাররা তো বটেই, স্পটে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন এসডিপিও ব্যারাকপুর। এসে গিয়েছেন অ্যাডিশনাল এসপি ব্যারাকপুরও।
উগ্র জনতার বিক্ষোভ উগ্রতর হয় এসপি-কে দেখে। একাধিক দাবি ছিটকে আসতে থাকে ভিড়ের মধ্যে থেকে। ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি না দিলে ব্লকেড উঠবে না! আজকের মধ্যেই বীজপুর থানার আইসি (ইনস্পেকটর-ইন-চার্জ)-কে বদলি করতে হবে! থানার দুশো মিটারের মধ্যে এই ঘটনা কীভাবে ঘটল, এসপি-কে প্রকাশ্যে তার জবাবদিহি করতে হবে, নয়তো বডি তুলতে দেওয়া হবে না!…’ ইত্যাদি।
অস্বাভাবিক কিছু নয়। যা ঘটেছে, যেভাবে ঘটেছে, এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফেটে না পড়লেই বরং অবাক হওয়ার ছিল। এসব ক্ষেত্রে যা প্রাথমিক করণীয়, সেটাই করলেন পুলিশ সুপার। জনতার বক্তব্য প্রায় আধঘণ্টা ধরে শুনলেন ধৈর্য ধরে। অন্নপ্রাশনের ভাত মুখে উঠে আসবে, এমন গালিগালাজ… পুলিশের চোদ্দোপুরুষের বাপ-বাপান্ত… শুনলেন মাথায় বরফ চাপিয়ে। জানতেন, ক্ষোভের বাষ্পটা যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবে, তত দ্রুত বডিটা তুলে পোস্টমর্টেমে পাঠানো যাবে। শুরু করা যাবে তদন্তের কাজ।
এসপি প্রতিশ্রুতি দিলেন, থানার টহলদারি ব্যবস্থা রাত থেকেই ঢেলে সাজানোর। নিশ্চয়তা দিলেন, মামলার তদন্তে পদস্থ আধিকারিকদের নেতৃত্বে আজই গঠন করা হবে ‘সিট’ (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম)। অবরোধ উঠল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের কথা-চালাচালির পর। রাস্তা একটু ফাঁকা হওয়ার পর এগোতে পারলেন পুলিশ সুপার। ‘বডি’ অবধি যেতেই পারেননি এতক্ষণ।
বছর চল্লিশের মহিলার দেহটা গলিতে পড়ে আছে নিথর। আটপৌরে শাড়ি পরনে। মাথা চুরমার হয়ে গেছে আঘাতের তীব্রতায়। অস্ত্রের আঘাত নয়। অনেক উঁচু থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার আঘাত। মৃত্যু যে এসেছে মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, সেটা বুঝতে অন্তত ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয় না। শরীরের অন্য কোথাও কোনও আঘাতের আভাস নেই।
রক্তাক্ত দেহটা যখন পুলিশ গাড়িতে তুলছে, মিডিয়া ছবি তুলছে খচখচ, জনতার ভিড়কে কোনওক্রমে ঠেকিয়ে রাখছে পুলিশি ব্যারিকেড, এসপি-র মনে পড়ে যায় সেই মাঝবয়সি ভদ্রলোকের কথা। যিনি একটু আগেই বিক্ষোভ চলাকালীন উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলছিলেন, ‘শুনুন সাহেব, আমি জন্মেছি এই পাড়ায়। এমন ঘটনা এই এলাকায় কখনও ঘটেনি। আপনার পুলিশ আছে কী করতে?’
সত্যি বলতে, ভদ্রলোক একটু কমিয়েই বলেছেন। এই কাঁচড়াপাড়ায় কেন, রাজ্যেই এমন ঘটনা অদূর বা সুদূর অতীতে ঘটেছে আর?
.
বীজপুর থানা। কেস নম্বর ৩২/২০০৮। তারিখ, ২১ ফেব্রুয়ারি। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৯৬ ধারায়। ডাকাতি এবং তার সঙ্গে খুনও।
কাঁচড়াপাড়া বাজারের একেবারে কেন্দ্রস্থলেই বিমল দাসের চারতলা বাড়ি। পঁয়তাল্লিশ বছরের বিমল পেশায় স্বর্ণব্যবসায়ী। এই বাড়িটা কিনেছেন তা প্রায় সাত-আট মাস হল। খোলনলচে বদলে দিয়ে বাড়িটা সাজাচ্ছেন নতুন করে। মাসখানেক ধরে মিস্ত্রিদের নিত্য যাওয়া-আসা। দিনভর ছুতোরের ঠুকঠাক।