শিবু এক পা পিছিয়ে গেল। চোখাচোখি হল আমার আর জিতের সঙ্গে। আমরা বুঝে গেলাম, গুপ্তা স্যার ঠিকই বলছেন। আমরা পাতি চ্যাংড়া। পুলিশ কেস খেয়েছি আগে। আর উনি বড় অফিসার। অনেক জানাশুনো। ঠিকই তো, আমাদের কথা কে বিশ্বাস করবে? আর উনি সিডি নিয়েছেন, দেখেছেন, আবার নিয়েছেন, কোনও প্রমাণ তো নেই এসবের! উনি এখন যদি পুলিশে কমপ্লেন করেন, আমরা ওঁকে কিডন্যাপ করে এখানে আটকে রেখে টাকা চেয়েছি, আমাদের জিন্দগি পুরো বরবাদ। ওঁকে বাঁচিয়ে রাখলে আমরা ফিনিশ হয়ে যেতাম স্যার!
—সে তো এখনও ফিনিশই হবি! বাকি জীবনটা জেলেই কাটাবি! যাক গে… তারপর?
—চোখে চোখে কথা হয়ে গেল আমাদের। শিবু লক্ষ্মীকে বলল, ‘ভিতরের ঘরে দড়ি আছে, চট করে!…. এই চন্দন… মুখটা চেপে ধর শিগগির…।’ আমি আর জিৎ মিলে মুখ চেপে ধরে খাটের উপর ফেলে দিলাম গুপ্তা স্যারকে। উনি হাত-পা নাড়িয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শিবু ছুরিটা গলার কাছে ধরল, উনি ভয়ে স্থির হয়ে গেলেন।
লক্ষ্মী ততক্ষণে নাইলনের দড়ি নিয়ে এসেছে একগোছা। শিবু আমাকে বলল, ‘দড়িটা দিয়ে ফাঁস দে গলায়, না হলে আমরা ফিনিশ হয়ে যাব।’ আমার হাত-পা কাঁপছিল স্যার। এমন হবে ভাবিনি তো আগে, মাথা কাজ করছিল না। শিবু ছুরি চালিয়ে দিল গুপ্তা স্যারের বুকে। আমি আর জিৎ মিলে দড়ির ফাঁস দিলাম গলায়। চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল একটু পরেই। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
—হুঁ…
—আমরা চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। শিবু-আমি-জিৎ-লক্ষ্মী আমরা চারজনই ঘামছিলাম। কী করতে কী হয়ে গেল! এখন উপায়? সবসুদ্ধ তো সেই জেলেই যেতে হবে।
শিবুই প্ল্যান বাতলাল একটা। বলল, ‘বাঁচার একটাই রাস্তা এখন। বেশি রাতের দিকে বডিটা খালাস করে দিতে হবে।’
—কীভাবে খালাস করলি?
খালাস-পর্বের সারসংক্ষেপ এই।
—সন্ধের পর শিবু বেরিয়ে গিয়ে একটা বস্তা জোগাড় করে আনল। দড়িও আনল বাড়তি। বডি পাওয়া গেলেও যাতে চট করে চেনা না যায়, তাই একটা থান ইট দিয়ে রাকেশের মুখটা থেঁতলে দিল জিৎ। তারপর বেরিয়ে গেল গাড়ির খোঁজে, যাতে নিয়ে যাওয়া হবে বডি।
…কিন্তু কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? লক্ষ্মী বলল, মুড়াগাছার পুকুরপাড়ের কথা। জিৎ একটা ম্যাটাডোর জোগাড় করে আনল রাত সাড়ে দশটায়। শিবু লক্ষ্মীকে বলল, একটা ব্লাউজ় আর লেডিজ় রুমাল আনতে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বডিটাকে বাঁধার পর ব্লাউজ় আর রুমালটা রাখলাম বডির উপর। বডি পাওয়া গেলে যাতে পুলিশ ভাবে, মেয়ে-কেসে উনি ফেঁসে গেছিলেন। এরপর বডি বস্তাবন্দি করা, বস্তাকে নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। আর রাত একটার পর ম্যাটাডোরে চাপিয়ে মুড়াগাছায় বস্তা ফেলে আসা।’
চন্দনের বয়ান শেষ হওয়া মাত্রই স্থির হয়ে গেল পরবর্তী করণীয়। চন্দনকে নিয়ে একটা টিম বেরল নিউ ব্যারাকপুরের সেই বাড়িতে, যেখানে রাকেশকে মারা হয়েছিল। খাটে এবং মেঝেতে রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে এখনও। পড়ে আছে বিয়ার আর হুইস্কির বোতল। চশমার ভাঙা টুকরো। পড়ে রয়েছে নাইলনের দড়ি কয়েকগাছা। হিন্দি বই কয়েকটা, অশ্লীল ছবি ভরতি। সিডিগুলো কোথায়? চন্দন জানাল, ‘বনগাঁর বাড়িতে আছে।’
অন্য আরেকটা টিম ততক্ষণে খড়দা থানায় পৌঁছে গেছে। অ্যারেস্ট রেজিস্টার থেকে জানা হয়ে গেছে, মিঠুন ওরফে জিৎ ঘোষ নামে এক যুবক কয়েকমাস আগে ছিঁচকে চুরির কেসে অ্যারেস্ট হয়েছিল। ভোরের মধ্যেই খড়দা থানার হাজতে ঠাঁই হল জিতের। বাড়ি থেকে উদ্ধার হল একটা দামি ঘড়ি আর সোনার আংটি।
বাকি ছিল লক্ষ্মী আর শিবু। লক্ষ্মীকে থানার স্থানীয় সোর্সরা সবাই চিনত। পাওয়া গেল বাড়িতেই। একটা গলার চেন উদ্ধার হল বাড়ি থেকে। শিবুকে পাওয়া গেল না ভোররাতের ‘রেইড’-এ। গত দু’-তিনদিন ধরে বাড়িতে নেই। মোবাইল নম্বরও সুইচ্ড অফ সেই থেকেই। শেষ টাওয়ার লোকেশন, হাওড়া স্টেশন চত্বর। শহরের বাইরে পালিয়েছে কিছু আঁচ করে?
পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ ডিজি-কে ফোনে ধরলেন পুলিশ সুপার।
—স্যার, ওই মার্ডারটা… ডিটেকটেড স্যার… থ্রি আউট অফ ফোর অ্যারেস্টেড…কনফেসও করেছে।
—ইজ় ইট? আমি তো ভাবছিলাম আজ আবার তোমাকে ফোন করব প্রোগ্রেস জানতে। হোয়াটস দ্য স্টোরি? কারা করল? কেন করল? উইমেন? অর ওয়েলথ?
—নাইদার স্যার। বাইসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ব্ল্যাকমেল।
ডিজি একটু থমকে যান শুনে। পুলিশ সুপার পুরোটা বলেন। বাক্যালাপ শেষে উচ্ছ্বসিত শোনায় রাজ্যের পুলিশ প্রধানকে, ‘হার্টিয়েস্ট কনগ্র্যাচুলেশনস! প্রাউড অফ ইয়োর টিম!’
ফোনটা রেখে একটা লম্বা শ্বাস নেন এসপি। ভাগ্যিস সেদিন রাকেশের বোন দাদার ছবির কোলাজ বানাচ্ছিলেন, ভাগ্যিস চোখ পড়েছিল রাকেশের কবিতাপাঠের ছবিতে!
প্রমাণ সংহত করে যত দ্রুত সম্ভব চার্জশিট জমা দেওয়ার জরুরি দায়িত্বটা আইসি ঘোলা তপনকুমার বিশ্বাসকে দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার। কিনারা-পরবর্তী অধ্যায়ে তপনই ছিলেন মামলার তদন্তকারী অফিসার।
নিউ ব্যারাকপুরের যে বাড়িতে খুন হন রাকেশ, তার পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক পরীক্ষা হয়েছিল। খাটে আর মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের নমুনা যে মানবদেহের, প্রমাণিত হয়েছিল। এবং সেই নমুনার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল পোস্টমর্টেম পর্বে সংগৃহীত রাকেশের ‘ব্লাড স্যাম্পল’, মিলে গিয়েছিল গ্ৰুপ। যে চশমার ভাঙা টুকরো পাওয়া গিয়েছিল ঘরে, তা যে রাকেশেরই, চিহ্নিত করেছিলেন আত্মীয়বন্ধুরা। জিতের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ঘড়ি-আংটি এবং লক্ষ্মীর বাড়ির তল্লাশিতে পাওয়া চেনও যে রাকেশরই, শনাক্ত হয়েছিল অনায়াসে। ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া বিয়ার-হুইস্কির বোতলে আঙুলের ছাপ মিলেছিল শিবু-চন্দন-জিতের। চন্দনের বনগাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় একডজন সমকাম-বিষয়ক সিডি।