আইসি ঘোলা আর থাকতে পারেন না, ‘তুই যেভাবে বলছিস, মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিস না। সবই শিবুর প্ল্যান। সবই শিবু বুঝিয়েছে, শিবু করিয়েছে। শিবু ধরা পড়লে ঠিক উলটো বলবে। বলবে, পুরোটাই তোর প্ল্যান।’
—না স্যার… বিশ্বাস করুন! শিবুই আমাকে…
—হয়েছে হয়েছে… বাকিটা বল…
—শিবু আর আমি ভাবতে বসলাম, কোথায় আনা যায় গুপ্তা স্যারকে? একটা বাড়ির ব্যবস্থা তো করতে হবে। কে করবে, কোথায় করবে? শিবু আমাকে বলল বাসুদার হেল্প লাগবে। ‘বাসুদা’ নিউ ব্যারাকপুর এলাকার নামকরা মস্তান ছিল একসময়। আমি আর শিবু গেলাম বাসুদার কাছে। বাসুদা ফুটিয়ে দিল আমাদের। বলল, ‘কোনও ঝামেলার মধ্যে আমি থাকি না আর, তোরা তো জানিসই।’
শিবু দমল না। বাসুদার বোন ফুলমণিকে চিনত আগে থেকে। গিয়ে ধরল একটু পরে। বলল, দিদি, একটা কিছু ব্যবস্থা করো। আমাদের ছোট একটা কাজ আছে। কোনও বাওয়াল হবে না। তোমাকে হাজার পাঁচেক দেব কাজ হয়ে গেলে। ফুলমণি মধ্যমগ্রাম বাজারে সবজি বিক্রি করে। টানাটানির সংসার। বলল, দাঁড়া, দেখছি। তোরা কাল আয়।
পরের দিন আবার গেলাম। ফুলমণি বলল, ‘ব্যবস্থা হয়েছে। নিউ ব্যারাকপুরে দাদার একটা পুরনো দোতলা বাড়ি আছে। বছরের অর্ধেক সময় খালি থাকে। মাঝে মাঝে আমি গিয়ে ঝাড়পোঁছ করে আসি। ওই বাড়িটার চাবি নিয়ে রাখব আমি। তোদের আজ বাড়িটা দেখিয়ে দিচ্ছি চল।’ বাড়ি দেখে এলাম।
—তারপর?
—যেমনটা প্ল্যান ছিল তেমনটাই হল। শিবু ঠিকই ধরেছিল। গত শনিবার ওঁর অফিসে গিয়ে সিডি আর ‘রিয়েল সিন’-এর কথা বলতে গুপ্তাজি রাজি হয়ে গেলেন। রবিবার দুপুর একটা নাগাদ মাইকেলনগরে আসতে বললাম। উনি বললেন, আড়াইটের আগে হবে না। ওই আড়াইটে নাগাদই ট্যাক্সি করে এলেন। আমি নিয়ে গেলাম বাসুদার বাড়িটায়। মাইকেলনগর মোড় থেকে হেঁটে মিনিট পনেরো-কুড়ি বড়জোর। ঢুকে দেখলাম, শিবুর সঙ্গে আর একটা ছেলে আছে। শিবু আলাপ করাল। বলল, নাম জিৎ। খড়দার ছেলে। আর ছিল লক্ষ্মী।
—লক্ষ্মী আবার কে?
—স্যার, ঘোলা এলাকাতেই থাকে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া। একসঙ্গে থাকে না। শিবুর সঙ্গে আগে অনেকবার দেখেছি। ওদের মধ্যে রিলেশন আছে একটা।
—বলতে থাক…
—ঘরটা খুব নোংরা অবস্থায় ছিল। তিন-চারটে খালি বিয়ারের বোতল মেঝেতে পড়ে ছিল। খাটের উপর বেশ কয়েকটা সিডি আর কয়েকটা হিন্দি চটি বই ছিল। গুপ্তাস্যার বুঝলাম হকচকিয়ে গেছেন। অভ্যেস নেই তো এইসব জায়গায় আসার। শিবু বলল, ‘বসুন স্যার, বসুন। আপনার একটু অসুবিধে হবে এখানে। কিন্তু এসব কাজ তো খুব ভদ্র জায়গায় করা মুশকিল, বোঝেনই তো…’
গুপ্তাজি বসলেন না। ওঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম, খুব অস্বস্তি হচ্ছে। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘এখানে প্রোজেক্টর কোথায়? সিডি-টা দেখব কী করে?’
শিবু বলল, ‘ওসব আধঘণ্টার মধ্যে এসে যাবে। ততক্ষণ আপনি এই বইগুলো দেখতে পারেন, হেব্বি হেব্বি ছবি আছে।’ তারপর জিৎ বলে ছেলেটাকে বলল, ‘সাহেবকে ঢেলে দে না একটা।’
জিৎ বলল, ‘বিয়ার খাবেন একটু স্যার? আপনার অনারে আজ ইংলিশ মালও আছে। হুইস্কি চলবে? একটু নেশাটা ধরুক, তারপর ‘‘রিয়েল সিন’’ হবে।’
গুপ্তা স্যার রেগে গেলেন। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চন্দন, হোয়াট ইজ় দিস? আমি এখানে মদ খেতে আসিনি। এসব কী? তুমি আমাকে সিডিগুলো দাও, আমি দেখে নেক্সট উইক ফেরত দিয়ে দেব।’
আমি বললাম, ‘স্যার, প্রোজেক্টর এসে যাবে একটু পরেই। আপনি একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আর এই সিডিগুলো বাইরে দেওয়া যাবে না, আপনাকে তো বলেছিলাম আগে!’
উনি এবার আরও খচে গেলেন, ‘আমি এখানে আর অপেক্ষা করতে পারব না। তোমার কথায় এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে, আমি চলে যাচ্ছি।’
গুপ্তা স্যার দরজার দিকে এগনো মাত্রই মেঝেতে বসা শিবু লাফ দিয়ে উঠল। সঙ্গে জিৎ-ও। দেখলাম, শিবু কোমরে গোঁজা ছুরি বার করেছে। লক্ষ্মী ছুটে দরজা আটকে দাঁড়াল। আর নিমেষের মধ্যে গুপ্তা স্যারের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল জিৎ। আমাকে দিয়ে বলল, ‘ফোনটা সুইচ অফ কর।’
গুপ্তা স্যার তখন ভয় পেয়ে গেছেন। আমার দিকে তাকালেন, বললেন, ‘মুঝে যানে দো।’
শিবু বলল, ‘স্যার, আপনাকে আমরা আটকে রাখব বলে আনিনি, আপনি শুধু পাঁচ লাখ টাকা আমাদের দেবেন সাতদিনের মধ্যে, ব্যস।’
গুপ্তা স্যার একটু সামলে উঠেছেন তখন। বললেন, ‘টাকা! কিসের টাকা! এক পয়সাও দেব না।’
শিবুর উত্তর রেডিই ছিল, ‘দিতে তো হবেই স্যার। না হলে আপনার মানইজ্জত সব মায়ের ভোগে যাবে। বাড়িতে বউ আছে…মেয়ে আছে… আরেকটা বাচ্চা হবে আর আপনি হোমো সিডির ডেলিভারি নিচ্ছেন মাসে মাসে, এটা পাড়ায়-অফিসে জানাজানি হলে লাইফ বিলা হয়ে যাবে স্যার… একটু ভেবে দেখুন… মাত্র তো লাখ পাঁচেক।’
গুপ্তা স্যার আবার খার খেয়ে গেলেন, চিল্লামিল্লি শুরু করলেন, ‘দেব না! শুনে রাখো, দেব না! একটা পয়সাও না! তোমরা যেখানে ইচ্ছে যা খুশি বলতে পারো। লোকে তোমাদের মতো পেটি ক্রিমিনালদের বিশ্বাস করবে নাকি আমাকে, সেটা আমিও দেখব। তোমাদের ধারণা নেই তোমরা কাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছ। অনেক মন্ত্রী, অনেক বড় অফিসারদের আমি পারসোন্যালি চিনি, তোমাদের সবক’টার মুখ চিনে রাখছি। এই জায়গাটাও আমার মনে থাকবে। সবাইকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব। চন্দন, তোমাকে সারাজীবন আফশোস করতে হবে এটার জন্য…’